।। নিউজ ডেস্ক ।।
কুড়িগ্রামের অনেক চরাঞ্চলে বছর ঘুরে ঈদ আসে ঈদ যায়, কিন্তু সেই আনন্দের সামান্য ছোঁয়াটুকুও লাগে না এখানকার অধিবাসীদের জীবনে। আর দশটা দিনের মতো কোনো পার্থক্য নেই ঈদের দিনের। প্রতিদিনকার মতো নৌকা-জাল নিয়ে মাছ ধরতে চলে যান বড়রা। জালে ভালো মাছ উঠলেই তাদের আনন্দ। শিশুরা মলিন কাপড়ে নিরানন্দই পার করেন ঈদের সারাটা বেলা। কোরবানির গোস্তের ম ম করা ঘ্রাণ, সে তো স্বপ্নেরও অতীত। কারণ এ অঞ্চলে যে ঈদুল আজহার গরু কোরবানিই হয় না, তাও অন্তত কুড়ি বছর ধরে।
এবারও ঈদের দিন খুব ভোরবেলা জাল নিয়ে বের হয়েছেন দাগারকুটিচরের বাসিন্দা বছির উদ্দীন। মাছ না পেয়ে বিষণ্ণ মনে ঘরে ফিরছিলেন। কুশল বিনিময় করতেই রাশভারী কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘মাছগুলাও এলা ক্যাওটা (দুরন্ত) হয়া গেইছে বাহে। জালত আসপার চায় না।’
বছির উদ্দীনের আশা ছিল জালে ভালো মাছ পড়বে। নদী থেকে ফিরে ঈদের নামাজ পড়ে সেগুলো বিক্রি করতে বাজারে যাবেন। মাছ বিক্রির টাকায় মাংস কিনে ছেলেমেয়েদের নিয়ে খাবেন। তার সে আশায় গুড়েবালি।
এ অবস্থা শুধু বছির উদ্দীনেরই নয়, কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের ছয়টি চরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেল একই চিত্র। দাগারকুটি, গুজিমারী, শ্যামপুর, নয়াপাড়া, গাবুরজান ও বাবুরচরের বাসিন্দারা জানালেন, ঈদের দিন শুধু মাছ ধরা নয়, কেউ কেউ হাঁস-মুরগি ধরে জবাই করে, সেটাই তাদের কাছে কোরবানি।
গুজিমারীচরের ছাদেকুল বলেন, এখানে ঈদের নামাজের মাঠ বলতে এক টুকরো শুকনো জমি। বাড়ি বাড়ি চাল তুলে একজন ইমাম নিয়ে এসে নামাজ পড়ি। এরপর যে যার মতো কাজে বেরিয়ে পড়ে। অন্যান্য দিনের চেয়ে ঈদের দিনের পার্থক্য শুধু ওই সকালের নামাজটুকুই।
পুরো চর ঘুরে নতুন পাঞ্জাবি-শাড়ি পরা নারী-পুরুষ দূরের কথা, নতুন জামাকাপড় পরা শিশুও চোখে পড়েনি। ছাদেকুল চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বললেন, বাচ্চাগুলোর মুখের দিকে তাকাইলে মনটা কেঁদে ওঠে। তিনটা বাচ্চা কারও জন্য কিছু আনতে পারিনি। বাড়ি ভাঙছে ১১ বার। বাড়ি বানাব, না খাবার কিনব, না কাপড় কিনব।
ছাদেকুলের ১১ বার বাড়ি ভাঙার কথা শুনে হেসে ওঠেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পঞ্চাশোর্ধ্ব মুস্তাফিজুর। হাসির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হামার বাড়ি ভাঙছে ২৩ বার; ওমার (ওদের) কেবল ১১ বার। হামাক কাটবার (অতিক্রম) পাইলো না তারা।’
মুস্তাফিজুরের এমন উত্তর শুনে হাসির রোল পড়ে গেল। ২৫-৩০ জন জড়ো হয়েছে সেখানে। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে থাকা স্থানীয় কলেজ শিক্ষক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘জাগি’র প্রতিষ্ঠাতা আবু হেনা মুস্তফা বলেন, জীবনের শেষ সম্বলটুকু ২৩ বার নদীর বুকে হারিয়ে যাওয়ার পরও যারা এভাবে প্রাণ খুলে হাসতে পারেন, তাদের হৃদয় না জানি কত বড়।
চরাঞ্চলের এসব মানুষের উদারতার পরিচয় মেলে ঈদের আগের দিনও। উলিপুরের বজরা ইউনিয়নের বিরহিমের চরে গিয়ে দেখা যায়, এখনও অনেক ঘরের কোনায় পানি। টিনে পানির দাগ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় বন্যার পানি চাল পর্যন্ত উঠেছিল। ঘরে হয়তো দুই কেজি চালও নেই। কিন্তু অতিথিপরায়ণ বাঙালির চিরাচরিত রূপের একটুও ম্লান হয়নি। ঘরে থাকা সামান্য বিস্কুট আর পানি দিয়েই আপ্যায়নের চেষ্টা করেন তারা।
তাদেরই একজন করিমন্নেছা বলেন, যাদের ভিজিএফ কার্ড আছে, ঈদ উপলক্ষে তারাই চাল সহায়তা পেয়েছেন। তার অভিযোগ, চেয়ারম্যানের চ্যালারা শুধু কার্ড পায়, তারা অভাবী হয়েও পান না।
বজরার জুম্মার হাটের মুচির বাঁধ থেকে নৌকায় তিন ঘণ্টায় দূরত্বের বিরহীম ও খামার দামারচরে ৭০০ পরিবারের বাস। বাসিন্দাদের অভিযোগ- ইউনিয়ন পরিষদ থেকে অনেক দূরে হওয়ায় শুধু ঈদ নয়, বন্যার সময়ও তারা সহায়তা পান না। বজরার ৫ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মহুবর রহমান বলেন, দূরত্ব এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় এখানে কেউ সহায়তা দিতে আসে না।
সরকারি-বেসরকারি সহায়তা না পেলেও থেমে থাকে না তাদের জীবন। যেমন ঘরে বসে থাকেননি ১০ ভাইবোনের মধ্যে সপ্তম এনামুল। ঈদের দিন নৌকা নিয়ে বের হয়েছেন যাত্রী পারাপার করে যা আয় হবে তা দিয়ে মাংস কিনে বোনের বাড়িতে নিয়ে যাবেন। নতুন বোন জামাইকে সঙ্গে নিয়ে পোলাও খাবেন।
গুজিমারীচরের মাঠে একদল কিশোরের ফুটবল খেলা দেখে সেখানে এগোতেই ঘামতে ঘামতে মোশাররফ জানালেন, বিবাহিত আর অবিবাহিত গ্রুপ ফুটবল খেলছে। অবিবাহিত দলের হয়ে তিনি এক গোল দিয়েছেন। তাই একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন।
পাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিলেন মধ্যবয়স্ক হাজেরা বেগম। তিনি বলেন, ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায় গোস্ত কই পাই বাহে। বন্যায় সহায়তা পেলেও ঈদে কিছু পাইনি।’ তার জীবনের এ পর্যন্ত এ চরে কোনো দিন গরু কোরবানি হতে দেখেননি।
শুধু গুজিমারীচর নয়, হাতিয়া ইউনিয়নের বাবুরচর, গাবুরজান, শ্যামপুর ও নয়াপাড়াচরে গত ২০ বছরেও পশু কোরবানি হয়নি বলে জানালেন এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিএম আবুল হোসেন। তিনি বলেন, এসব চরে তিন হাজারেরও বেশি মানুষের বাস। ঈদে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে চাল সহায়তা দেওয়া হয়। সরকারের পাঠানো চালের পরিমাণ কম থাকায় সবাইকে দেওয়া সম্ভব হয় না।
পুরনো পোশাকেই ঈদের নামাজ পড়েন কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের চর পার্বতীপুরের বাসিন্দারা। চরে বিত্তবান কেউ না থাকায় কারও ঘরে ওঠেনি কোরবানির মাংস। যার ঘরে যা আছে সেটুকুই রান্না করতেই ব্যস্ত দেখা গেল গৃহিণীদের।
ঘরের পাশে খোলা জায়গায় রান্না করছিলেন মেহেরজান। তিনি জানালেন, আলু ভাজি আর সাদা ভাত দিয়েই সকালটা পার করবেন। বাড়ির পুরুষরা নদীতে জাল ফেলেছেন। তারা মাছ নিয়ে এলে হয়তো রাতে মাছ রান্না হবে।
ঈদের পর দিন বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের বিন্দুরচরে কথা হয় ইদ্রিস আলীর সঙ্গে। জাল পেতে বসে আছেন মাছের অপেক্ষায়। জালে যেদিন মাছ বেশি পড়ে, সেদিনই তার ঈদ বলে জানান।
এ চরে সন্ধ্যায় দেখা যায় একদল কিশোর ফাঁকা জায়গায় তাঁবু গেড়ে উচ্চৈঃস্বরে গান বাজিয়ে হৈহুল্লোড় করছে। তাদেরই একজন হযরত আলী জানাল, তার মতো সমবয়সী যারা ঢাকায় বিভিন্ন কাজ করে, তারা ঈদের ছুটিতে এসেছে। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এভাবে গান বাজিয়ে নাচবে সবাই মিলে। গত দুই বছর ধরে তারা ঈদের পর দিন মিলিত হয়ে এমন আয়োজন করে।
দুর্গম চরাঞ্চলে দুস্থদের মাঝে সরকারিভাবে কোরবানির মাংস বিতরণ হয় কি-না জানতে চাইলে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন বলেন, বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া ২৮টি গরু কোরবানি দিয়ে এর মাংস উলিপুর ও চিলমারী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে দুস্থদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে পাওয়া কিছু ত্রাণসামগ্রীও বিতরণ করা হয়েছে।
সূত্রঃ সমকাল