|| আব্দুল মালেক ||
উলিপুরে ধান, চাল ও গম ক্রয়ে খাদ্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি গম, ধান ও মিলারদের কাছ থেকে চাল ক্রয়ের কথা থাকলেও তা না করে ভারপ্রাপ্ত খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা একটি আস্থাভাজন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রকল্পের ডিও সমন্বয় করে গম ও চাল ক্রয় করছেন বলে গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এছাড়াও গত ২ সপ্তাহ আগে ওই গুদাম কর্মকর্তার পছন্দের ৩টি পরিত্যক্ত চাল কলের সাথে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ধান ছাঁটাইয়ের চুক্তি করেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ২জন মিল মালিক চুক্তির ব্যাপারে কিছুই জানেন না। এমন লাগামহীন দূর্নীতির কারনে সরকারের ক্রয় অভিযান ভেস্তে যেতে বসেছে। এসব দূর্নীতির সাথে উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক ফজলুল হক একমত না হওয়ায় তাকে নানাভাবে হেনস্ত করার পর জরুরী ভিত্তিতে বদলী করা হয়। এ ঘটনায় উপজেলার ধান চাষী, সাধারণ মিল মালিক ও সুশীল সমাজের মাঝে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে প্রথম দফায় উপজেলায় ৬‘শ ৩৭ মেট্রিক টন ধানের বরাদ্দ আসে। প্রশাসন ও শাসক দলের টানাপোড়নের কারনে বেশ বিলম্বে দুই দফায় লটারি অনুষ্ঠিত হয়। বিলম্বের ফাঁদে পড়ে প্রকৃত কৃষকরা তাদের কষ্টার্জিত ফসল বাজারে পানির দরে বিক্রি করে দেয়। এদিকে, লটারি অনুষ্ঠানের পর পর খাদ্য গুদাম কেন্দ্রিক সরকারী দলের পরিচয়ে গড়ে উঠা একটি সক্রিয় সিন্ডিকেট গুদাম কর্মকর্তার যোগসাজশে নির্বাচিত কৃষকদের জাতীয় পরিচয় পত্র ও কৃষি কার্ড সংগ্রহ করে তাদের স্বাক্ষর জাল করে গুদামে ধান বিক্রয় করে আসছেন। অন্যদিকে, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মহিবুল হক অত্যন্ত গোপনে নিয়মবহির্ভূত ভাবে ১‘শ মেট্রিক টন ধান ছাটাইয়ের জন্য ‘রাজা-রানা’ চাউল কলে ৩০ মেট্রিক টন, ‘রিফাত’ চাল কলে ৩০ মেট্রিক টন ও ‘আজাদ’ চাল কলের সাথে ৪০ মেট্রিক টন ধান ছাটাইয়ের জন্য চুক্তি সম্পাদন পূর্বক বরাদ্দপত্র প্রদান করেন। কিন্তু চুক্তির ২ সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও গত শনিবার সরেজমিনে ‘রিফাত’ চাল কল ও ‘আজাদ’ চাল কলে গিয়ে দেখা যায় এসব মিলে বয়লার, হাউজ, চাতাল, গুদামঘর দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। সেখানে ধান ছাঁটাইয়ের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। আজাদ চাল কলের মালিক আবুল কালাম আজাদ হতবাক হয়ে বলেন, ধান ছাটাইয়ের জন্য চুক্তিবদ্দ হয়েছি এমন খবর আপনাদের মাধ্যমে জানলাম। রিফাত চাল কলে গিয়ে দেখা যায় মিলটি দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যাক্ত রয়েছে। স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি মিল মালিক মাহাবুবার রহমান তার ছোট ভাই সালু মিয়ার কাছে মিলটি বিক্রি করে দিয়েছেন। অপরদিকে, উপজেলায় ধান ছাটাইয়ের জন্য সচল মিল থাকলেও পরিত্যাক্ত মিলের সাথে গোপনে চুক্তি করায় জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিয়ে সাধারণ মিলারদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ী মহলের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, উলিপুর খাদ্য গুদামে সক্রিয় সিন্ডিকেটটির সাথে গুদাম কর্মকর্তা অবৈধ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছে। ছাঁটাইয়ের বিষয়টি গোপন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে ওই কর্মকর্তা ধান ছাঁটাইয়ের বরাদ্দ আদেশ পেয়ে ১’শ মে.টন ধান মিল তিনটিতে প্রেরণ না করে নির্বাচিত কৃষকদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও কৃষি কার্ড নিয়ে কাগজ কলমে ধান ক্রয় দেখিয়ে মনোনিত ব্যক্তির সাহায্যে ডব্লিউ.কিউ.এস.সি‘র মাধ্যমে সিন্ডিকেটের হাতে টাকা তুলে দেয়। এরপর সিন্ডিকেটটি সময়মত বাজার থেকে নিম্নমানের চাল কিনে তা ধান ছাঁটাইয়ের চাল হিসেবে গুদামে জমা দিচ্ছে। প্রতিমণ ধানের সরকারি মূল্য ১ হাজার ৪০ টাকার বিপরীতে বর্তমান বাজারে ২৬ কেজি চালের মূল্য ৫২০ টাকা, এতে প্রতিমণ ধানে লাভ হচ্ছে ৫২০ টাকা। ১’শ মে.টন ধান ছাটাই দেখিয়ে তারা মোট লাভ করেছেন ১৩ লক্ষ টাকা।
এদিকে, মিল মালিকদের সাথে নুতুন চাল ক্রয়ের চুক্তি হলেও একই পদ্ধতিতে বাজার থেকে নিম্নমানের চাল ক্রয় করে গুদামে দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেট চক্র। এতে গুদাম কর্মকর্তা প্রতি কেজিতে পিসি ছাড়াও অতিরিক্ত ৫ টাকা পকেটস্ত করছে।
এদিকে ১‘শ ৩১ মেট্রিক টন গম ক্রয়ের জন্য লটারির মাধ্যমে ২৬২ জন কৃষক নির্বাচিত করা হয়। গত জুনের ২৬ তারিখ পর্যন্ত সিন্ডিকেটের সহায়তায় কৃষকদের ভোটার আইডি/কৃষি কার্ড নিয়ে তাদের স্বাক্ষর জাল করে মাত্র ৫৪ মেট্রিক টন গম সংগ্রহ দেখানো হয়। পরে অবশিষ্ট ৭৭ মেট্রিক টন গম অস্বাভাবিক গতিতে মাত্র ৩ দিনে ক্রয় দেখানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, ডিও’র মাধ্যমে সরবরাহ করা পুরাতন গম কিনে খামালের মাঝখানে রেখে চতুর্দিকে নতুন গমের বস্তা দিয়ে খামাল সাজানো হয়েছে। যার হিস্যা পাচ্ছেন অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুস সালাম মিয়া ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মহিবুল হক। এসব অসাধু কর্মকর্তার কারণে সরকারের সংগ্রহ অভিযানের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত ধানের বাজারে ধস নামছে।
এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা মনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আমার এখানে কোন অনিয়ম হয় না। আর উপজেলা দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুস সালাম মিয়া অনিয়মের বিষয়টি অস্বীকার করে ধান ছাঁটাইয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ মিলের তালিকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মহিবুল হকের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আগে বললে এসব ব্যাপারে খতিয়ে দেখা যেত। রংপুর বিভাগীয় আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক রায়হানুল কবিরের সঙ্গে এসব অনিয়মের বিষয়ে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি দূর্নীতির বিষয়গুলো এড়িয়ে যান। খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানমের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, নীতিমালা অনুযায়ী মিল পরিদর্শনের পর ছাঁটাইয়ের জন্য মিল মালিকদের সাথে চুক্তি হবে। এখানে নীতিমালার যদি কোন ব্যত্যয় ঘটে তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।