।। আব্দুল মালেক ।।
উলিপুরে বুড়িতিস্তা নদী খননে ব্যাপক অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। সাড়ে ৩১ কিলোমিটার নদী খননে প্রাক্কলন অনুযায়ী উঁচু তলদেশে ১০ ফুট ও নিচু তলদেশে ৮ ফুট খননের নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ এলাকায় তা মানা হয়নি। কোথাও না কেটে, কোথাও আবার নদীর তীর বা পার না বেঁধেই খনন অব্যাহত রেখেছে। দখলদারদের রক্ষায় ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে নদীর গতিপথ। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ একটি মসজিদ। এমন অভিযোগ করেছেন বুড়িতিস্তা পারের মানুষজন।
এদিকে বিত্তশালীদের স্থাপনা না সরিয়ে গরিব কৃষকদের আধা পাকা ধান নষ্ট করে খনন অব্যাহত রাখায় বিক্ষুব্ধ কৃষক ও বুড়িতিস্তা বাঁচাও উলিপুর বাঁচাও আন্দোলনের কর্মীরা সোমবার (১৩ এপ্রিল) দুপুরে একটি অংশের খনন বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের সাফ কথা-আগে পাকা স্থাপনা সরাও তারপর কৃষকের ধানক্ষেত খনন করো।
বুড়িতিস্তা বাঁচাও উলিপুর বাঁচাও আন্দোলনের শরিক সংগঠন রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণ-কমিটির উলিপুরের সভাপতি আপন আলমগীর অভিযোগ করেন, বুড়িতিস্তা আন্দোলনের সুত্রপাত হয়েছিল গুনাইগাছ ব্রিজের মুখ ভরাট করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকে কেন্দ্র করে। যার প্রেক্ষিতে সরকার ডেল্টা প্ল্যানের আওয়তায় এই নদীটি খননের উদ্যোগ নেন। এই কাজে নিয়োজিত ঠিকাদার এমদাদ হোসেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নানা কৌশলে ব্রিজের মুখে খনন শুরু না করে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। পরে চাপের মুখে স্কেভেটর মেশিন সেখানে আনলেও কাজ না করে মেশিন সরিয়ে নিয়েছেন। অন্যদিকে, আরেক দিকে খুঁরে নদীর গতিপথ ঘুরিয়ে দিয়েছেন। নদীর উপর অবৈধ স্থাপনা যে অবস্থায় ছিল, সে অবস্থায় রয়ে গেছে।
নারিকেলবাড়ি গ্রামের আয়নাল হক জানান, তার জমির আধা পাকা ধান কেটে খনন কাজ শুরু করে। ১৫ দিন গেলে ধানগুলো ঘরে তোলা যেত। এজন্য তারা ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে সময় চেয়েছিলেন। কিন্তু সময় দেন নাই। এই জমি তাদের দলিল মুলে কেনা, এবং বহু বছর ধরে ভোগ দখল করে আসছিলেন। তারপরও খনন করা হয়। কিন্তু নদীর খাস জমিতে প্রভাবশালীদের বিল্ডিং গড়ে তুললেও রহস্যজনক কারণে তা না ভেঙ্গে নদী সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। একই অভিযোগ ভদ্র পাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম, রাকিবুল ইসলাম, আশরাফ আলী ও জয়নাল আবেদীনের। তাদের বক্তব্য আমাদের আধা পাকা ধান কেটে নদী খন করা হল। অথচ নদী ভরাট করে প্রভাশালীদের গড়া বিল্ডিং যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেল।
এদিকে খনন কাজের শুরুতেই ঠিকাদার নি.ম ক্রাউন ব্যাপক অনিয়মের আশ্রয় নেন। তিনি শত শত ট্রাক মাটি ইটভাটা মালিকদের কাছে বিক্রি শুরু করলে এলাকায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলে মাটি বিক্রি বন্ধ হয়।
ধামশ্রেণী ইউনিয়নের শুঁড়ির দারা গ্রামের আব্দুল করিম জানান, শুড়ির দারা ব্রিজের মুখে খনন না করেই মেশিন অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে। স্কেভেটরের চালক বলেছেন এখানে খনন করা লাগবে না। এ গ্রামের আশরাফুল ইসলাম জানান, নদী যে পরিমাণ গভীর করে খোঁরার দরকার ছিল ওইভাবে খোঁরা হচ্ছে না। খননের মাটি এমন জায়গায় ফেলা হয়েছে বৃষ্টি এলে ওগুলো গলে পানির সাথে নদীতে পড়ে আবার ভরাট হয়ে যাবে বুড়ি তিস্তা। এ প্রসঙ্গে নি.ম. ক্রাউন বলেন, ‘আমরা মাটি বিক্রি করছি না। শিফটিং করছি’। কাজ সঠিকভাবে করা হচ্ছে।
সরেজমিন গুনাইগাছ ব্রিজ এলাকা শুড়ির দারা গ্রাম ও উলিপুর পৌর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নদী খননে নানা অনিয়মের চিত্র। গুনাইগাছ ব্রিজ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ব্রিজের মুখ ভরাট ও বন্ধ করে মার্কেট গড়ে তুলেছেন আখতারুজ্জামান অপু। সেখানে মার্কেটের অর্ধেক অংশে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও উপজেলা ভুমি অফিসের সার্ভেয়ার দিয়ে সিমানা নির্ধারণ করে লাল রং দিয়ে চিহ্নিত করে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঠিকাদার ওই স্থাপনা অপসারণ না করে খননে ব্যবহৃত মেশিন অন্যত্র নিয়ে গেছেন। ওই এলাকার মানুষজন অভিযোগ করেন, সরকারি দলের প্রভাবশারী কয়েকজন নেতা দখলদারের পক্ষ নিয়ে উচ্ছেদ কাজে বাঁধা দেন।
এ ব্যাপারে আখতারুজ্জামান অপুর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, তাদের মালিকানাধীন জায়গা ভরাট করে বিপণী বিতান করেছেন। এতে দোষের কিছু নাই। স্থাপনা না ভেঙ্গে কাজ না করে স্কেভেটর মেশিন নিয়ে যাওয়া ও বিভিন্ন অংশে না খুঁড়ে আরেক অংশে যাওয়া প্রসঙ্গে ঠিকাদার এমদাদ হোসেন বলেন, স্থাপনা ভাঙ্গার কাজ তার নয়। নিয়ম মাফিক কাজ করা হচ্ছে।
বুড়িতিস্তা বাঁচাও উলিপুর বাঁচাও আন্দোলনের অন্যতম শরিক সংগঠন উলিপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু সাইদ সরকার বলেন, বুড়িতিস্তা নদী দখল করে বিপণী বিতান গড়ে তোলার বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করেছিলাম। উলিপুরের হাজার মানুষ সে আন্দোলনে অংশ নেয়। যদি ওইসব স্থাপনা না সরানো হয় তাহলে বাকি কাজ বন্ধ করে দিয়ে হলেও উলিপুর বাসীকে নিয়ে আবার আন্দোলন গড়ে তুলবো। অবৈধ স্থাপনা না সরানো পর্যন্ত সে আন্দোলন চলবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম বলেন, ১৭ কোটি টাকা ব্যায়ে দু’টি গ্রুপে প্রধানমন্ত্রীর ডেল্টা প্ল্যানের আওতায় বুড়ি তিস্তার খনন কাজ শুরু হয়। ১৯ কিলোমিটার খননের জন্য একটি গ্রুপের কাজ পান ঠিকাদার এমদাদ হোসেন, অপর গ্রুপের সাড়ে ১২ কিলোমিটার খননের কাজ পান নি.ম ক্রাউন নামের আরেক ঠিকাদার। ২ ফেব্রুয়ারি কার্যাদেশ দেয়া হয় যা চলমান আছে। দখলদারদের স্থাপনা অপসারণ না করে স্কেভেটর মেশিন সরিয়ে নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অপসারণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
খনন কাজ দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত উপ-সহকারি প্রকৌশলী শরীফুল ইসলাম দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন কাজে ফাঁকি দেয়ার কোনো উপায় নেই। ফাঁকি দিলে বিল পাবেন না। এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের টাস্কফোর্স পরিদর্শণ করার পর চুড়ান্ত বিল দেয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আব্দুল কাদের জানান, গত ১২ মে তারিখে জেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায় বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছে। ওই সভায় চিলমারী উপজেলা চেয়ারম্যান শওকত আলী বীর বিক্রম অভিযোগ তোলেন, চিলমারী উপজেলার অংশে বুড়িতিস্তা নদী খননে অনিয়ম হচ্ছে। স্কেভেটর দিয়ে খনন না করে শ্যালো ড্রেজার দিয়ে বালি উত্তোলন করে খনন করা হচ্ছে।
বুড়িতিস্তা খনন কমিটির সভাপতি ও কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন বলেন, তিনি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীর সাথে কথা বলবেন। সেখানে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি রয়েছে বলে শুনেছি। আরো কাগজপত্র পরিক্ষা করে ও সরজমিন ঘটনাস্থলে ঘুরে এসে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। পৌর এলাকায় বুড়িতিস্তার ৬ কিলোমিটার এলাকা কৃষকদেরও ব্যাক্তি মালিকানাধীন জমি। সেগুলো খনন করা হল কেমন করে- এ প্রশ্নে র জবাবে তিনি বলেন, যদি হয়ে থাকে সেটাও তিনি দেখবেন- কিভাবে খনন হল।