।। বশির আহমেদ ।।
চিলমারীর ব্রহ্মপুত্রের ওপারে চরবেষ্টিত গয়নার চরের ময়না। বয়স মাত্র ৩৬। বিয়ে হয় শিশু বয়সেই একই গ্রামের তারেক রহমানের সঙ্গে। সন্তানধারণের উপযুক্ত বয়স না হতেই জন্ম দেন দুই সন্তান। এর পরেই শুরু হয় রোগশোক। প্রথমে দেখা দেয় বাতজ্বর। ১৫ বছর ধরে ব্যথার বড়ি খেতে খেতে ধরা পড়ল যক্ষ্ণা। স্বামী অতিষ্ঠ- প্যাটোত ভাত নাই ফির ঔষধ মারাছিস! ময়নার অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় ভাই আব্দুল গফুর জ্ঞাতিদের সহযোগিতায় চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে এসে চিকিৎসা করান। ধীরে ধীরে সুস্থ হন তিনি। সুখ বুঝি আসে; কিন্তু তা আর হলো না। কষ্টের সংসারে নানা চিন্তার মাঝে স্বামীর শরীরে কখন যে ক্যান্সার ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে, টেরও পায়নি।
বেশি দিন সময় দেয়নি, মাস দুয়েকের মাথায় মারা যান তারেক। ২০১৫ সালে হঠাৎ করে পচন ধরে শরীরে। যেখানে হাত দেয় সেখানেই দাগ হয়ে রক্ত জমে, পচে, ছড়ায় দুর্গন্ধ। দুর্গম চর পাড়ি দিয়ে ভর্তি করা হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এরপর সেখানেই কেটে যায় দুই বছর। মেডিকেল অফিসার ডা. মোস্তারী বেগম ও সেবিকারাই হয়ে ওঠেন তার স্বজন। হাসপাতাল-সমাজসেবা-কোম্পানির ভিজিটের স্যাম্পল (ওষুধ) আর ডাক্তারের নিজস্ব অনুদানে চলে চিকিৎসা।
একদিন হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে তার ভাই আব্দুল গফুর বোনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলে বাড়ি নিয়ে যায়। বাড়িতে গিয়ে ময়না ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। একসময় ময়নার দেহ নিথর হয়। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীরা ধরে নেন তিনি মারা গেছেন। নাকফুল খুলতে গেলে চেতনা ফিরে আসে তার। সারা চরে আবারও রোল ওঠে-মরা মানুষ বাঁচি উঠছে বাহে। পরে ধীরে ধীরে কিছুটা সুস্থ হন তিনি।
সবাইকে চমকে দিয়ে ময়না একমাস পর হঠাৎ একদিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হাজির। ডাক্তার-নার্স সবাই তাকে দেখে অবাক! আজরাইলের মুখ থেকে ফিরে এসে সে আবারও ভর্তি হয় আপন ঠিকানায়। ক’দিন বাদে ফের অসুস্থ হতে থাকে সে। দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে শরীর থেকে।
গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর স্থানীয় কমিউনিটি রেডিও চিলমারী ৯৯.২ এফএমের এক প্রতিবেদক তাকে নিয়ে তৈরি করে ফেলেন ‘হাসপাতালেই যেন ময়নার ঠিকানা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন। পরের দিন ‘দুই বছর ধরে হাসপাতালে’ শিরোনামে আরও একটি সংবাদ একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। খবর দুটি কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন ও সিভিল সার্জন ডা. এসএম আমিনুল ইসলামের নজরে এলে পরদিন ওই দুই কর্তা দেখতে আসেন ময়নাকে। দায়িত্ব নেন চিকিৎসা ও আবাসনের। গত বছরের ১৫ অক্টোবর তাকে পাঠানো হয় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। দীর্ঘ ২৫ দিন সেখানে চিকিৎসা নিয়ে ব্যবস্থাপত্রসহ ৯ নভেম্বর ফিরে আসেন চিলমারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। রংপুরে থাকা অবস্থায় টাকার সংকট পড়লে অনেকে সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন। চিলমারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩ দিন ভর্তি থেকে ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ডাক্তারদের সহযোগিতায় ওষুধপত্র নিয়ে ভাইয়ের বাড়িতে ফিরে যায়। উপার্জন না থাকায় ভাইয়ের বউ বাড়ি থেকে বের করে দেয়। অসুস্থ শরীর নিয়ে চলে যান বোনের বাড়ি। দু’দিন না যেতেই বোন-জামাইয়ের দুর্ব্যবহারে ফিরে আসেন অজানার পথে। তারপর এ-বাড়ি, ও-বাড়ি এভাবেই চলে যায় চার মাস। কোনো রকমে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ফিরে আসে চিলমারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ভর্তি করা হয় ফিমেল মেডিসিন ওয়ার্ডে। কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন জানিয়েছেন, তার সুচিকিৎসার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আনা হয়েছে। তাকে পুরোপুরি সুস্থ করতে চাইলে ছয় মাস মেয়াদে কিছু ইনজেকশন দিতে হবে, যা ব্যয়বহুল। প্রয়োজন লাখখানেক টাকা।
জেলা প্রশাসক চিলমারী উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নির্দেশ দিয়েছেন, ময়নাকে সরকারিভাবে বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার জন্য। এখন কথা হচ্ছে, ময়না যে জীবন অতিক্রম করছেন, তা জীবন-মরণের ঢেউয়ে দুলছে। যদি জীবনে না বাঁচে, কী করং মুই বাড়ি দিয়া।
সূত্রঃ samakal