।। নিউজ ডেস্ক ।।
কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের শিক্ষকদের দুর্ভোগ আর ভোগান্তিতে ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান কার্যক্রম। শুষ্ক মৌসুমে নদী পার হয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটা আর বর্ষা মৌসুমে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল নদী পাড়ি দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছানোর পর মানসিক বিপর্যয় ঘটাকেই এর জন্য দায়ী করছেন শিক্ষক সমাজ।
আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চরাঞ্চলের শিক্ষকদের বিশেষ প্রণোদনা চালু এবং বদলি জটিলতা নিরসনসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, শিক্ষকদের মানসিক চাপ দূর করা না গেলে এ সমস্যা কাটবে না।
দেশের বৃহত্তম নদ-নদীময় জেলা কুড়িগ্রাম। এখানে ১৬টি নদ-নদীতে ৪৮০টি ছোট-বড় চরাঞ্চল রয়েছে। ৯টি উপজেলায় ৭৩টি ইউনিয়ন, ৩টি পৌরসভায় প্রায় ২২ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। এর মধ্যে ৬০/৬৫টি ইউনিয়নের নদ-নদী বেষ্টিত চরে প্রায় ৫ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। প্রত্যন্ত এই জনপদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে রয়েছে সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। জেলায় ১২৩৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে চরের ২০৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন প্রায় সহস্রাধিক শিক্ষক।
দেশে শতভাগ প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার কার্যক্রম চালালেও ব্যাহত হচ্ছে চরাঞ্চলে শতভাগ শিক্ষা কার্যক্রম। বিছিন্ন যোগাযোগ আর দীর্ঘদিন একই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক থাকার কারণে ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান। এছাড়াও চরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো এবং শিক্ষক সঙ্কটের কারণে ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষকদের দাবি, যাতায়াতের জন্য বেতনের সিংহভাগই খরচ করতে হয়। এমন শত-শত ভোগান্তির কারণেই বিঘ্নিত হচ্ছে চরের পাঠদান ব্যবস্থা। বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয় নারী শিক্ষকদের। এতে করে অনেকটাই বাধ্য হয়ে চরে অনেক প্রতিষ্ঠানে ভাড়াটিয়া শিক্ষক দিয়েই চলছে পড়ালেখা।
সরেজমিনে দেখা যায়, চিলমারী নৌবন্দর থেকে প্রায় ১ ঘণ্টা নৌপথ পাড়ি দিয়ে ফের প্রায় দেড় ঘণ্টা হেঁটে একটি বিদ্যালয়ে পৌঁছানোর পর ঘড়িতে বেলা সাড়ে ১১টা বেজে গেছে। আবার ফিরতে হবে বিকেল ৩টার নৌকায়। এই নৌকা ধরতে না পারলে ফেরা হবে না শিক্ষকদের। ফলে বাধ্য হয়েই ১টা বা দেড়টার মধ্যে স্কুল ছুটি দিয়ে দেন শিক্ষকরা। চরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে যাতায়াতে দৈনন্দিন ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়।
চর বেলমনদিয়ার খাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫০ জন। পদ সংখ্যা ৫টি হলেও আছেন ৪ জন শিক্ষক। একটি পদ শূন্য দীর্ঘদিন থেকে। এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চলতি দায়িত্বে আছেন ৫-৬ মাস। কিন্তু সহকারী শিক্ষক আনোয়ারুল হোসেন ১৩ বছর এবং লায়লা বানু ৮ বছর ধরে আছেন।
চিলমারী ১নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৫০ এর অধিক শিক্ষার্থী। এখানে শিক্ষকের ৫টি পদের বিপরীতে ৪ জন থাকলেও একজন শিক্ষক মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। এছাড়া বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোস্তফা আলী ১৩ বছর এবং সহকারী শিক্ষক শারমীন আকতার ও ফিরোজা বেগম ১০ বছর ধরে আছেন। এমনই অবস্থা প্রায় সবগুলো স্কুলের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক জানান, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদ্যালয়ে আসতে হয়। শহরের শিক্ষকের তুলনায় চরের শিক্ষকরা অনেক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। চরের শিক্ষক হওয়ার কারণে অফিস কিংবা সমাজে অবজ্ঞার স্বীকার হয়ে থাকি আমরা। চরের স্কুল বলেই অবকাঠামো এবং বরাদ্দের ক্ষেত্রেও বঞ্চনার স্বীকার আমরা। বদলীর জন্য দীর্ঘদিন থেকে চেষ্টা করেও লাভ হচ্ছে না।
তাদের অভিযোগ, যারা আসেন তারা বছর ঘুরতে না ঘুরতে লবিং আর অর্থের বিনিময়ে রাতারাতি বদলি বা ডেপুটিশনে শহরের ভালো স্কুলগুলোতে যাচ্ছেন। চরে একঘেয়েমি পরিবেশের কারণে মানসিক বিপর্যয় ঘটছে চরের শিক্ষকদের। ফলে শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে পাঠদানে মনযোগী হতে পারছেন না অনেকেই।
অনেক অভিভাবক বলেন, শিক্ষকরা স্কুলে আসেন ১১টা-১২টার দিকে। সিরিয়ালের নৌকা ধরার জন্য আবার তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দেন। এখানে নামকাওয়াস্তে লেখাপড়া চলছে।
এ বিষয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ জানান, চরাঞ্চলের মানসম্মত পাঠদানের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষক সঙ্কট দূর, চরের শিক্ষকদের বিশেষ প্রণোদনা চালুসহ অত্যন্ত ২/৩ বছর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বদলি পদ্ধতি চালু করা উচিত।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন স্বীকার করেন, চরাঞ্চলে প্রক্সি টিচারসহ নানা সমস্যার কারণে শিক্ষার মান সন্তোজনক নয়। এই বিষয়ে নীতিমালা সংশোধন প্রয়োজন। দ্রুত সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেয়ার কথাও জানান তিনি।
সূত্রঃ jagonews24