বাদশাহ্ সৈকত : কুড়িগ্রামের চরগুলো এখনো প্রায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। ব্রহ্মপুত্রের বুকে জেগে ওঠা দুই শতাধিক চরে প্রায় চার লাখ মানুষের বাস। নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত এসব মানুষ নিজেদের চেষ্টায় অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের সমৃদ্ধির পথে অলঙ্ঘনীয় দেয়াল হয়ে আছে যোগাযোগ সমস্যা।
চরগুলোয় ঘুরে দেখা গেছে, চরের ভেতরে চলাচলে কোনো সড়ক নেই। সরু আইল আর উঁচুনিচু জমির ওপর দিয়ে হেঁটে চলতে হয়। নদীপথে একমাত্র ভরসা নৌকা। চরে যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণে সরকারি কোনো দপ্তরে নেই পরিকল্পনাও।
এ অবস্থায় কোনো প্রয়োজন হলে মাইলের পর মাইল হেঁটে পার্শ্ববর্তী উপজেলা সদরে যেতে হয়। অসুস্থ অথবা সন্তানসম্ভবাকে হাসপাতালে নিতে হয় কাঁধে করে। ফলে বাধ্য না হলে কেউ হাসপাতালে যান না। ছোটখাটো রোগ বছরের পর বছর শরীরে পুষে রাখেন। গত কয়েক বছরে চরগুলো কৃষিতে বেশ এগিয়ে গেলেও ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না কৃষকরা।
কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর ঘাট থেকে নৌকায় করে ব্রহ্মপুত্রে ১ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিলে অষ্টআশির চর। সাত বছর আগে জেগে ওঠা এ চরে বসতি গড়ে উঠেছে প্রায় পাঁচ বছর আগে। সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকার ভোগান্তির কথা জানান প্রথমদিকে বসতি গড়া বাসিন্দা কাইছাল আলী।
তিনি জানান, হাটবাজারে যেতে চাইলেও অনেকদূর পথে হেঁটে তারপর খেয়াঘাটে পৌঁছতে হয়। নৌকা থেকে নেমে আবারো চরের বালিতে বেশ পথ হাঁটতে হয়। বর্ষায় আরো বিপদে পড়েন তারা। তখন চারদিকে শুধু পানি।
দুর্গম চরাঞ্চলের নারীদের অবস্থাও খুব করুণ! ৮০ শতাংশ নারীর জীবদ্দশায় চিকিৎসার উদ্দেশ্য ছাড়া কখনো উপজেলা বা জেলা শহরে যাওয়া হয়নি। বিচ্ছিন্ন কোনো চরেই কেটে যায় তাদের সারা জীবন!
কুড়িগ্রামের নয়টি উপজেলার চার শতাধিক চরের মধ্যে জনবসতি আছে ২৩০টিতে। চরের জনসংখ্যা চার লক্ষাধিক। কৃষি বিভাগের হিসাবে, ২২ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়। চারবাসী বালুময় জমিতে অনেক খেটে চীনাবাদাম, কাউন, ধান, ডাল, ভুট্টা, গম, চিনা, তিসি, গুজি তিল, তিল, কালিজিরা, ধনিয়া, শলুক, মিষ্টি আলু, মিষ্টিকুমড়াসহ নানা ফসল উৎপাদন করেন। হাঁস-মুরগির পাশাপাশি গরু, ভেড়া, ছাগল পালন করেও বাড়তি আয় করেন তারা। অনেকে নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
কিন্তু এ হাড়ভাঙা খাটুনির ফসল বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে পারেন না চরবাসী। সদর উপজেলার বড়ুয়ার চরের অহর উদ্দিন (৫০) জানান, এত কষ্ট করে ফসল করি, কিন্তু ভালো দামে বেচতে পারি না। নৌকা ভাড়া করে সবাই একসঙ্গে ফসল নিয়ে যাত্রাপুর হাটে যাই। পাইকাররা ইচ্ছেমতো দাম দেয়, কারণ তারা জানে এতদূর এসে আমরা সে ফসল ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারব না!
রোগব্যাধিতে চরবাসীর ভরসা গ্রাম্য ডাক্তার। সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের রলাকাটার চরের বাসিন্দা সোনা উল্যা বলেন, বড় রোগ হলে রোগীকে তক্তার ওপর বিছানা পেতে শুইয়ে ভাড় সাজিয়ে ঘাটে নিই। বেশির ভাগ শিশুরই জন্ম হয় বাড়িতে। প্রসবকালীন জটিলতা দেখা দিলে আল্লাহর ওপর ভরসা করে থাকি।
চরের মানুষের এ দুর্দশা লাঘবে কোনো উদ্যোগ আছে কিনা জানতে কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে খোঁজ নেয়া হয়। সবাই জানান, তাদের চরের জন্য আলাদা প্রকল্প নেই।
কুড়িগ্রাম স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ আব্দুল আজিজ বলেন, চরের জন্য আলাদা প্রকল্প না থাকায় আমরা সেখানে কোনো রাস্তা করিনি। বিষয়টি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ওপরও কিছুটা নির্ভর করে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
একই কথা বলেন কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন। তবে ৪০ দিনের কর্মসূচিসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে চরাঞ্চলে আন্তঃযোগাযোগের রাস্তা নির্মাণ করা হয়ে থাকে বলে জানান তিনি।
জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদী ঘেঁষা ২১৪ কিলোমিটার তীর রক্ষা বাঁধই সংলগ্ন চরবাসীর চলাচলের একমাত্র ভরসা। কিন্তু বাঁধগুলো বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় যান চলাচলও প্রায় বন্ধ। এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, জেলায় আরো নতুন বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা আছে।
সুত্র:বণিক বার্তা , জানুয়ারি ০৩, ২০১৯