বাদশাহ্ সৈকত :
কুড়িগ্রামে দুধের খামার করে যেসব বেকার যুবক স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন, তারা এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন! গো-খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও ক্রেতা সংকটে ফেরি করেও দুধ বেচতে পারছেন না তারা। বেসরকারি দুটি প্রতিষ্ঠান নিয়মিত কিছু দুধ কিনলেও তা সরবরাহের তুলনায় যথেষ্ট নয়। তাছাড়া তারা যে দাম দিচ্ছে তাতে লাভ তো দূরের কথা কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা লোকসান হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে অনেক সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তা দুগ্ধখামার বন্ধ করে দেয়ার কথা ভাবছেন।
কুড়িগ্রাম শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণপুর গ্রামের খামার মালিক আদম আলী। তিনি জানান, দুগ্ধখামার লাভজনক জেনে দুই বছর আগে ছয়টি উন্নত জাতের গাভি ১২ লাখ টাকায় কিনে খামার শুরু করেন। শুরুর দিকে বেশ লাভ হতে থাকে, এক বছর পর এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে আরো পাঁচটি গরু কেনেন। এরপর কেনেন আরো নয়টি। এখন তার খামারে মোট গরু ২৮টি। এর মধ্যে আটটি বাছুর। ১২টি গাভী গর্ভবতী।
এতগুলো সুস্থ-সবল গরু থাকলেও মনে শান্তি নেই আদম আলীর। খামারে প্রতিদিন উৎপাদিত প্রায় সাড়ে তিন মণ দুধ ফেরি করে বেচতে হচ্ছে তাকে। ক্রেতা মূলত চা, মিষ্টির দোকান। তাও আবার ক্রেতারা চান বাকিতে কিনতে। নগদ চাইলে ৫০ টাকা কেজির দুধ ৩৬ থেকে ৩৭ টাকায় বেচতে হয়। অথচ গো-খাদ্য কিনতে হয় ৩৫ টাকা কেজি দরে।
আদম আলীর চেয়েও করুণ অবস্থার মধ্যে আছেন রাজারহাট উপজেলার চাকিরপাশা ইউনিয়নের পীরমামুদ গ্রামের মংলা সাধু। তার খামারে শতাধিক উন্নত জাতের গরু। প্রতিদিন দুধ পান ১০ থেকে ১২ মণ। এই দুধের বেশির ভাগই কিনছে ব্র্যাক, আরডি এবং সমবায় সমিতি। বাকিটা শহরের বিভিন্ন মিষ্টি ও চায়ের দোকানে ফেরি করে বেচতে হয়।
মংলা সাধুর ছেলে রতন জানান, রাজারহাটে আগে ডেইরি ফার্ম অনেক কম ছিল। তখন দুধ বিক্রি করতে কিছুটা সমস্যা হলেও ভালোই লাভ হয়েছে। কিন্তু এখন এই উপজেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৪০০ খামার। সে তুলনায় ক্রেতা বাড়েনি। ফলে দুধ নিয়ে বিপদে পড়তে হচ্ছে। ব্র্যাক, আরডি ও সমবায় সমিতি দুধ কিনছে প্রতি কেজি ২৬ থেকে ৩১ টাকায়। ফ্যাটের পরিমাণ কম দেখিয়ে সস্তায় দুধ কিনছে তারা। তবে সামান্য কিছু দুধ মিষ্টি ও চায়ের দোকানে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা দরে বিক্রি করা যায়।
এমন অবস্থা শুধু আদম আলী বা মংলা সাধুর নয়, জেলায় বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে শত শত যুবক অনেক আশা নিয়ে দুগ্ধখামার করেছিলেন। তাদের এখন পথে বসার জোগাড়!
রাজারহাট উপজেলার উমরমজিদ ইউনিয়নের ফরকেরহাট এলাকার নতুনগড়ে নতুন একটি দুগ্ধখামারের মালিক রানা। ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষে পছন্দমতো চাকরি না পেয়ে গ্রামে এসে ছয়টি গাভি কিনে খামার শুরু করেন। এই কটি গরুর দুধও বিক্রি করতে পারছেন না তিনি। প্রায় পাঁচ মণ দুধ অবিক্রীত থেকে নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর একটি ফ্রিজার কিনেছেন। কিন্তু তাতেও সংকট কাটেনি। লোকসানে পড়ে চরম হতাশায় ভুগছেন তিনি।
দুধের দাম কম দেয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজারহাট উপজেলার ব্র্যাক দুধ ক্রয়কেন্দ্রের ইনচার্জ আসলাম মোল্লা বলেন, ৩ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে ফ্যাট থাকলে সেই দুধ নিই না। অন্য কোনো সদস্যা পেলেও নেয়া হয় না। ৩ দশমিক ৫ শতাংশ ফ্যাটের দুধের মূল্য নির্ধারণ করা আছে ২৮ টাকা ৯০ পয়সা।
জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা গেছে, কুড়িগ্রামে নিবন্ধিত দুগ্ধখামার ৫৮৫টি। এর বাইরে আছে ৪৪৮টি। কিছু খামার হিসাবের বাইরেও আছে। খামারিরা জানান, ছোট-বড় মিলিয়ে জেলায় এখন খামারের সংখ্যা দুই সহস্রাধিক। ক্রেতা সংকট ও ফ্যাট পরিমাণ জটিলতায় ভুগছেন এই খামারিরা।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আব্দুল হাই সরকার দুধ বিক্রিতে খামারিদের হয়রানির শিকার হওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, শুধু রাজারহাটে ব্র্যাকের দুটি, আরডির একটি ও স্থানীয় খামারিদের সমবায় সমিতির মাধ্যমে একটি ক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। আমরা জেলার প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মিল্ক ভিটা দুধ ক্রয়কেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ পাঠিয়েছি।
সুত্র:বণিক বার্তা, সেপ্টেম্বর ০২, ২০১৮