নিউজ ডেস্কঃ
জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় আসা ভিটেমাটিহারা সেই পথশিশু ও মা রাতের গাড়িতেই নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে কুড়িগ্রাম ফিরে গেছেন। দুই বছর আগে নদীর ভয়াল থাবা ভিটেমাটি গ্রাস করে নিলে পাথুরে শহর ঢাকায় এসেছিলেন তারা।
গত শুক্রবার হাজার অসহায় মানুষের মতো রাস্তায় জ্বর নিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ফরিদা (৩৫)। এ সময় অসুস্থ মাকে বাঁচাতে মাথায় পানি ঢালছে ৩ বছরের ছেলে ফরিদুল। পাশে বসে রাস্তার খাম্বায় হেলান দিয়ে আছে ১১ বছরের বামন মেয়ে।
এমন মানবিক দৃশ্যের ছবি তুলে সাক্ষী হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইফুল ইসলাম জুয়েল নামের এক পথচারী। এরপরই এমন দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করেছে পারভেজ হাসান নামেরআরেক পথচারী।আর সেটি স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়।
পরে যুগান্তর অনলাইনএ মানবিক ঘটনার সংবাদ প্রকাশ করে। তাদেখে দেশ-বিদেশ থেকে সাহায্যের জন্য অসংখ্য ফোন আসে। এমন সাহায্যের আশ্বাসে রোববার রাতেই ওই পরিবারের খোঁজে নামে যুগান্তর টিম। অনেক অনুসন্ধানের পরে তাদের খুঁজে পেয়ে জানতে চাওয়া হয় তাদের স্বপ্নের কথা।
তখন তারা জানায় ইটপাথুরে ঘেরা কোটি মানুষের শহর ঢাকা ছেড়ে নিজ গ্রামে ফিরে যেতে চান। আর এই খবর বাড়ি “ফিরে যেতে চান সেই অসুস্থ মা”শিরোনামে প্রকাশ করে যুগান্তর অনলাইন। এরপর এমন মানবিক সংবাদ নজরে আসে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসকের।
পরে ওই পরিবারের খোঁজ নিতে বুধবার যুগান্তরের সহযোগিতা নেন দাপ্তরিক কাজে ঢাকায় অবস্থানরত জেলা প্রশাসক। সরেজমিনে গিয়ে কথা বলে সেই পথশিশু ও মায়ের দায়িত্ব নেন। এমন মানবিক ঘটনা প্রকাশের জন্য যুগান্তরকে ধন্যবাদ দেন কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক। সেই সঙ্গে যারা ওই পরিবারকে সহযোগিতা করেছে তাদেরও ধন্যবাদ জানান। আর জেলা প্রশাসকের এমন আশ্বাসেই ঢাকা ছেড়ে কুড়িগ্রাম যেতে রাজি হন সেই পথশিশু ও মা।
এছাড়া ঢাকাস্থ কুড়িগ্রাম সমিতির মহাসচিব ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। তিনি ও তার সংগঠন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সমন্বয় করে ওই পরিবারকে সব ধরনের সাহায্যের আশ্বাস দেন। বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ৯টার দিকে রাজধানীর আসাদগেট থেকে ছেড়ে যাওয়া কোচে কুড়িগ্রাম সমিতির তত্ত্বাবধানে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছেন তারা।
এদিকে রাতে কুড়িগ্রাম সমিতির মহাসচিব মো. সাইদুল আবেদীন ডলার জানান, ঢাকা থেকে ওই পরিবারের সবকিছু গুছিয়ে সমিতির স্বেচ্ছাসেবকসহ তিনি তাদের কুড়িগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া গাড়িতে তুলে দেন। এ সময় কুড়িগ্রাম সমিতির অন্যান্য নেতারা ও সেফটি স্কুলের নির্বাহী পরিচালক সাখাওয়াত স্বপনসহ উৎসুক জনতা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে রাত ৮টার দিকে কুড়িগ্রাম সমিতির মহাসচিব তার প্রাইভেটকারে করে তাদের কলাবাগান ফুটওভার ব্রিজের নিচ থেকে আসাদগেট বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে যান। ওই পরিবারের সবাইকে নতুন জামাকাপড়,খাবার ও নগদ টাকা হাতে তুলে দেন।
সকাল সাড়ে ৭টায় পরিবারটি কুড়িগ্রাম শহরে পৌছলে তাদেরকে কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবে নিয়ে আসা হয়। এখানে নিজের জীবনের কথা শোনান ফরিদা বেগম (৪০) ও তার স্বামী আনছার আলী (৬০)।
জেলার উলিপুর উপজেলার প্রত্যন্ত বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ইসলামপুর মৌজার মরাকাটি গ্রামে বাড়ি ছিল ফরিদার স্বামী আনছার আলীর। ছিল ২ একর ধানী জমি। দুধের ব্যবসা করে ভালই চলছিল পরিবারটি। চরের মধ্যে প্রতিদিন ২ মন করে দুধ সংগ্রহ করে ১৫ কিলোমিটার সাইকেল মাড়িয়ে কুড়িগ্রাম শহরে হোটেলগুলোতে দুধ সরবরাহ করত সে। এভাবেই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু ব্রহ্মপূত্র নদের করাল গ্রাসে ২০১৬ সালে একমাসের মধ্যে বাড়ীঘর, আবাদি জমি সব গ্রাস করে ফেলে। গৃহহীন হয়ে পরে গৃহস্ত পরিবারটি। তাদের সাথে দেড়শ পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে ফেলে। শেষে আশ্রয় মেলে ইসলামপুরে জ্যাঠাত ভাইয়ের গোয়ালঘরে। সেখানে একমাস থাকার পর ঢাকায় চলে আসে পরিবারটি।
ফরিদা বেগম জানান, “বাবারে অনেক কষ্টের জীবন মোর। জন্মিয়া শোনং মোর বাপ জন্মের আগোত মরি গেইছে। জন্মের ৭দিনের মাথাত মোর মাও বলে মরি যায়। বাপ-মা মরা এতিম ছওয়ার কাঁইয়ো দায়ভার নেয় নাই। ৫ বছর বয়সোত অভাবোত পরি মোর নানী কুলসুম আর খালা তারামনি মোক সিতাইঝাড়োত ছিন্নমুকুল এনজিওত থুইয়া আইসে। সেটে ৭ বছর থাকপের পর ক্লাস ছিকসোত পড়বের সময় ছিন্নমুকুল ভাঙি দেয়। মুই নানীর বাড়িত ফিরি আইসং। সেটে মোর বিয়ে দেওয়া হয়। ৩ মাসের মাথাত মোর বিয়া ভাঙি যায়। ইয়ার দুই বছর পর আনছার আলীর সাথে মোর বিয়ে হয়। ওমারও এটা দ্বিতীয় বিয়েও। ওমার প্রথম বউ আমেনা ডায়রিয়া হয়া মরি যায়।”
এই হল ভাঙন কবলিত আনছার আলী আর ফরিদা বেগমের জীবন কাহিনী। অভাব-অনটন আর মাথা গোজার ঠাঁই না পেয়ে তারা নভেম্বর মাসে ঢাকায় পাড়ি দেয়। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে শেষে আশ্রয় নেয় কলাবাগান ওভারব্রীজের নীচে পলিথিন বিছিয়ে। এখানে ধানমন্ডী ক্লাবে দাড়োয়ান জামালের সহযোগিতায় মাঠের পাতা কুড়ার কাজ করে দিনে আয় হয় দুশো থেকে আড়াইশ টাকা। সেই অর্থেই চলছিল মানবেতর জীবন যাপন। মাঝখানে কাজটাও বন্ধ হযে যায়। এসময় প্রায় না খেয়ে থাকতে হচ্ছিল পরিবারটিকে। সন্তানদের দু:খ-কষ্ট সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ্য শরীর নিয়ে নিজেই ভিক্ষাবৃত্তি করতে বেড়িয়ে পরেন ফরিদা বেগম। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে আকলিমা (১১) একজন প্রতিবন্ধী (বামন), দ্বিতীয় কন্যা সন্তান আখিতারা (৭) কে তারা গ্রামের বাড়িতে চাচীর কাছে রেখে এসেছেন। একমাত্র ছেলে ফরিদুল (সাড়ে ৩) তাদের কাছে থাকে।
ফরিদা বেগম জানান, “ঘটনার দিন দুসন্তানকে নিয়ে কলাবাগান থেকে ল্যাব এইডের দিকে ভিক্ষা করতে বের হন। অসুস্থ্য শরীর নিয়ে বের হওয়ার ফলে ল্যাব এইডের কাছে অসুস্থ্য হয়ে ফুটপাতেই পরে যান তিনি। সেই স্মৃতি মনে করে ফরিদা বেগম জানান, ছওয়া দুইটা না খায়া আছে। মা হয়া কেমন করি বসি থাকং। অসুস্থ্য শরীর নিয়া ভিক্ষা করার জন্যে বের হয়া পড়ং। ঘোড়ের মইধ্যে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় চোখমুখ আন্ধার দেখি সেটেই উল্টি পড়ং। মনে হবার নাগছিল আজক্যা মনে হয় মোর শ্যাষ দিন। বড় বেটি মোক ধরি থাকে। আর ছোট বেটা মাথাত পানি ঢালে। তারপর কি হইল কাঁই জানে। মোক পরদিনোত লোকজন হাসপাতালোত নিয়ে যায়।“
সন্তানসহ পুরো পরিবারটি কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবে আসলে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র দেন সিভিল সার্জন ডা: এসএম আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি মেডিকেল টিম। এ সময় প্রাথমিকভাবে পরিবারটির খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় চাল, ডাল, তেল, লবনসহ সমস্ত উপকরণ সরবরাহ করেন রেল, নৌ-যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি কুড়িগ্রামের সভাপতি তাজুল ইসলাম।
কুড়িগ্রাম গণকমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা কুড়িগ্রামের উন্নয়নে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছি। আমাদের ১২টি দাবির সাথে কুড়িগ্রামের সকল ভূমিহীনদের পূণর্বাসন সংক্রান্ত দাবিটি সংযুক্ত করছি।
কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি এড. আহসান হাবীব নীলু জানান, বন্যা আর নদী ভাঙনে প্রতিবছর শত শত পরিবার বাড়িভিটা হারাচ্ছে। নদী তীরবর্তী উন্মুক্ত এলাকায় নদী শাসনের ব্যবস্থা না করায় বানভাসী ও গৃহহীনদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ফরিদার মতো হাজারও মানুষ এখন বড় বড় শহরের পথে ঘাটে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এসব মানুষদের পুনরবাসন করা জরুরী।
সিভিল সার্জন ডা: এসএম আমিনুল ইসলাম জানান, নিয়মিত খাদ্য আর পুষ্টির অভাবে পুরো পরিবারটি স্বাস্থ্যহীনতায় ভুগছে। খাবার ও প্রযোজনীয় ঔষধপত্র পেলে আস্তে আস্থে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমিন আল পারভেজ জানান, জেলা প্রশাসনের নির্দেশে উপজেলা প্রশাসন এ পরিবারটিকে অস্থায়ী ভাবে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিশ্চিত করা হয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা। জেলা প্রশাসক মোছা: সুলতানা পারভীনের নির্দেশে তাদের তিন সন্তানকে স্কুলে ভর্তির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোসাম্মত সুলতানা পারভীন জানান, সরকার প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের সকলের উচিৎ সরকারের এ কাজে সহযোগিতার হাত বাড়ানো। অসহায় ফরিদার পরিবারকে জমিসহ স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। একই সাথে করা হবে কর্মসংস্থানের।