নিউজ ডেস্কঃ
এখনো আবদুল কাদেরের তেমন কোনো রোজগার নেই। বাড়িতে অভাব। তবু তাঁর জ্ঞান ফেরি করা চাই। গ্রামে গ্রামে, স্কুলে স্কুলে আবদুল কাদের বই বিলিয়ে বেড়ান। উঠান বৈঠকে নারীদের জানান স্বাস্থ্য ও কৃষি কথা। তিনি চান হিংসামুক্ত সচেতন সমাজ। আব্দুল খালেক ফারুক দিনকয় আগে দেখা করে এসেছেন।
শনিবারের সকাল ছিল সেটা। সূর্যের তেজ ছিল। কাদের ছিলেন পশ্চিম পলাশবাড়ীতে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই বিতরণ করছিলেন। নিজের টিউশনির টাকা থেকেই খরচাপাতি। সাড়ে ৫০০ বই আছে তাঁর। পর্যায়ক্রমে বিতরণ করেন। মাসে একবার সেরা পাঠক নির্বাচন করেন। পুরস্কারও দেন। তাঁর একটা সাইকেল আছে। সাইকেলের পেছনে একটা লোহার খাঁচা আছে। বিশেষভাবে তৈরি। বই রাখেন, তাতে আছে একটি নিবন্ধন খাতাও। উপন্যাস, মুক্তিযুদ্ধের বই ছাড়াও নানা ধরনের বই রাখেন। কুড়িগ্রাম শহরের খলিলগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজ আর কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজে চলে তাঁর ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার। এ পাঠাগার আছে পলাশবাড়ী ছাড়াও আরো তিনটি গ্রামে। খলিলগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সালমা বেগম বলেন, ‘পাঠক তৈরির পাশাপাশি ভালো মানুষ তৈরির কাজও করেন কাদের ভাই। আমরা নিয়মিতই তাঁর কাছ থেকে বই নিই।’
মায়েদের পাঠশালা
পশ্চিম পলাশবাড়ী, জোলাপাড়া, চেরেঙ্গা আর নিজ গ্রাম পূর্ব বড়ভিটায় কাদের পরিচালনা করেন মায়েদের পাঠশালা। মাসে একবার করে প্রতি গ্রামে উঠান বৈঠক করেন। বাড়ির পাশে সবজি চাষ, বৃক্ষরোপণ, ঝগড়া-বিবাদ থেকে মুক্ত থাকা এবং স্বাস্থ্যসচেতনতা বিষয়ে আলাপ করেন বৈঠকে। উঠান বৈঠকে উপস্থিত থাকেন—এমন কয়েকজন বললেন, ‘কাদের নিজ খরচে আমাদের ব্লেড আর সাবান কিনে দিতেন প্রথম প্রথম। এখন তো আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। সবজির বীজ আর গাছের চারাও দিয়েছেন অনেক। কাদেরের আলোচনা ভালো লাগে বলেই কাজটাজ গুছিয়ে হাজির হয়ে যাই। আমাদের অনেকেই কাদেরের কাছে লেখাপড়াও শিখেছে।’
সৎ মানুষের খোঁজে
সমাজে সৎ মানুষ কমে যাচ্ছে। তাই কাদের সৎ মানুষ খোঁজার কাজ হাতে নিয়েছেন। সৎ মানুষ খুঁজে পেতে দারুণ এক বুদ্ধিও বের করেছেন। নগদ অর্থ, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র আর নিজের ঠিকানা একটি মানিব্যাগে ভরে জনবহুল জায়গায় ফেলে রেখে দেন। মানি ব্যাগটি যদি কেউ অক্ষত অবস্থায় ফেরত দেন, তাহলে ওই ব্যক্তিকে স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতিতে সততা ‘সম্মাননা’ প্রদান করেন কাদের। কাদের চান ছাত্র-ছাত্রীরাও এটা দেখে অনুপ্রাণিত হোক। কাদের বললেন, সৎ মানুষ খোঁজার মিশনে তিনি ২৫টি মানিব্যাগ ফেলে রেখেছিলেন আর সৎ মানুষ পেয়েছেন চারজন। সংখ্যায় যতই কম হোক, কিছু সৎ মানুষ এখনো আছে। এটাই খুশির কথা। এ ছাড়া দুটি স্কুলের নির্দিষ্ট কক্ষে (সদর উপজেলার আত্মারাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হরিকেশ নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল) সততা স্টোর প্রতিষ্ঠা করেছেন। এসব স্টোরে কোনো বিক্রেতা নেই। পণ্য সাজিয়ে পাশে নির্ধারিত মূল্য লিখে রাখা আছে। শিক্ষার্থীরা পছন্দমতো পণ্য কিনে বাক্সে টাকা জমা রেখে যান।
এক কাপ চা
ভালো কাজের পুরস্কারস্বরূপ কাদের গ্রামের লোকদের চা-ও খাওয়ান। এ ক্ষেত্রে নিয়ম হলো, গ্রামের একটি নির্দিষ্ট দোকানে একটি খাতা রাখা থাকে। সে খাতায় কে কোন ভালো কাজ করল, তা লেখা হয়। কাদের সেটা দেখে দিনের বা সপ্তাহের সেরা ভালো কাজ করা কয়েকজনকে চা খাওয়ান। ছয় মাসে ৭০০ জন লোক সে খাতায় নাম লিখেছেন বা লিখিয়েছেন। পলাশবাড়ী গ্রামের আবদুস ছামাদ বলেন, ‘কাদের মিথ্যা কথা বলে না। সব সময় মানুষের ভালো চায়। আমরা তাঁকে ভালোবাসি।’
শিক্ষাসংক্রান্ত কাজ
ঝরে পড়ার হার রোধ এবং শিক্ষামুখী করতে নানা কার্যক্রম হাতে নেন কাদের। মাঝেমধ্যে মা সমাবেশ করেন। মায়েদের জানান, কেন সন্তানকে লেখাপড়া শেখানো জরুরি। স্কুলগুলোতে সুন্দর হাতের লেখা প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, কুইজ, ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। গরিব শিক্ষার্থীদের নিয়ম করে মাসে একবার খাতা ও কলম সরবরাহ করেন। বিজয়ীদের পুরস্কারও দেন। স্কুলে কুইজ প্রতিযোগিতা, সুন্দর হাতের লেখা প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ক্রীড়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করেন। গরিব শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে প্রতি মাসে সাধ্যমতো খাতা ও কলম সরবরাহ করেন কাদের। তা ছাড়া হাতে লেখা পত্রের চল ধরে রাখতে কলেজ পর্যায়ে বছরে একবার ‘মায়ের কাছে লেখা চিঠি’ শীর্ষক প্রতিযোগিতারও আয়োজন করেন।
সামাজিক সব কাজ
দুর্নীতি, সড়ক দুর্ঘটনা, খাদ্যে ভেজাল, বাল্যবিয়ে, বৃক্ষরোপণ, যৌতুক, নারী নির্যাতন, মাদক ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য রাস্তায় রাস্তায় আর দোকানপাটে লিফলেট বিলি করেন কাদের। মাঝেমধ্যে মাইকিংও করেন। কুড়িগ্রামের ১৭টি ছাত্রাবাসে আত্মহত্যা ও মাদকবিরোধী ক্যাম্পেইন করেছেন। কুড়িগ্রাম শহরের সাতটি স্কুলে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করেছেন। কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার উত্তর বড়ভিটা গ্রামে চার বছর কৃষকদের নিয়ে কৃষক উৎসবও করেছেন।
বড় ভালো লাগে
আবদুল কাদেরের বাড়ি ফুলবাড়ী উপজেলার উত্তর বড়ভিটা গ্রামে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। জমিজমাও নেই তেমন। বড় ভাইয়ের আয়ের ওপরই নির্ভরশীল। আর টিউশনি করে পাঁচ হাজার টাকার মতো পান। কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস বিভাগে স্নাতকোত্তর হয়েছেন ২০১৩ সালে। সরকারি চাকরি পাওয়ার বয়স বেশি নেই আর। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চেষ্টা করেও লাভ হয়নি সে রকম। এর মধ্যেও কাদের বলেন, ‘প্রচারের জন্য নয়, ভালোলাগা থেকেই কাজ করে যাই। যদি আরো সঙ্গী পাই তো খুশি হই।’ জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ তাঁর কথা প্রচার করেছে। এটাই তাঁর এ যাবৎ একমাত্র প্রাপ্তি।
সূত্রঃ AllBanglaNews