নিউজ ডেস্ক: সংগত কারণে পানিকে আমরা জীবন বলি। অন্য যে কোনো খাবার না খেয়েও শুধু পানি পান করেই মানুষ ২১ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। অহিংস ও অবিসংবাদিত নেতা মহাত্মা গান্ধী হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য নিয়ে একটি অনশন ধর্মঘট করতে গিয়ে ৭৪ বছর বয়সে ২১ দিন পানি ব্যতীত অন্য কোনো খাবার না খেয়ে বেঁচেছিলেন। অধিকাংশ চিকিৎসা বিজ্ঞানী মনে করেন, একজন সুস্থ মানুষ শক্ত খাবার ব্যতীত শুধু পানি পান করে সর্বোচ্চ আট সপ্তাহ বাঁচতে পারে। আর পানি ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে মাত্র সাত দিন।
একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের শরীরের ৬০ শতাংশ পানি। শিশুদের ক্ষেত্রে তা ৭৪ ভাগ। পানি শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় ও দূষিত উপাদানগুলো কোষের বাইরে নিয়ে আসে, কোষে পুষ্টি উপাদান পৌঁছে দেয়, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ও খাবার হজমে সাহায্য করে। যথেষ্ট পরিমাণে পানি না পান করলে ভীষণ জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। অন্য সব উপাদানের মতো পানি ও তাতে দ্রবীভূত লবণের একটি সুষম অবস্থা বিরাজ করা সুস্থ জীবন যাপনের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। খেয়াল করুন, সুষম অবস্থা- কম বা বেশি নয় কিন্তু। কারণ, পানি স্বল্পতার মতো পানির আধিক্যও বিপদ ডেকে আনতে পারে। সাম্প্রতিক কয়েকটি খবর এ বিষয়টি নিয়ে ভাববার অবকাশ তৈরি করেছে। যারা শারীরিক কসরত করেন, বিশেষ করে ম্যারাথোন দৌড়বিদগণ অনেক সময় পানি স্বল্পতা রোধ করতে এবং কিছু মানুষ বাজি ধরে একসঙ্গে অনেক পানি খেয়ে ফেলেন। এ পানি কিডনিকে ভারাক্রান্ত করে। একবারে যতটুকু পানি কিডনি ছাঁকতে পারবে তার থেকে বেশি পানি এখানে জমা হয়ে যায়, যা সে বের করতে পারে না। এ পানি তখন শরীরের অন্য সেলে জমা হতে থাকে। যখন পানি ব্রেইন সেলে জমে তখনই ঘটে বিপত্তি। সজ্ঞা হারানো থেকে শুরু করে কোমা, শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তাই, প্রয়োজনের যা বেশি তাতে আমাদের কাজ নেই।
শরীরে কী পরিমাণ পানি প্রয়োজন, তা কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। যেমন কাজের ধরন, ওজন, খাবারের ধরন, শরীরে সঞ্চিত চর্বির পরিমাণ, চারপাশের পরিবেশ বিশেষ করে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ও তাপমাত্রা প্রভৃতি। যিনি খোলা মাঠে কাজ করেন আর যিনি অফিস কক্ষে বসে কাজ করেন, তাদের পানির প্রয়োজনীয়তা এক সমান নয়। আবার আপনি যদি লবণ জাতীয় খাবার বেশি খান, তবে অতিরিক্ত লবণ শরীর থেকে বের করতে অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণ পানি প্রয়োজন হবে সে লোকটির থেকে যিনি কম লবণ খান। এভাবে শুকনো খাবার বেশি খেলেও দেহকে হাইড্রেটেড রাখতে অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণ পানির প্রয়োজন। তথাপি দিনে একজন মানুষ কী পরিমাণ পানি পান করবেন, এ বিষয়ে একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে। তা হলো ৬৪ আউন্স বা আট আউন্সের গ্লাসে আট গ্লাস পানি যাকে অনেক সময় সহজ করে ৮ ঢ ৮ নিয়ম বলা হয়। সমস্যা হচ্ছে, ব্যস্ত নাগরিক জীবনে অনেকেই এ নিয়মটি অনেকে মেনে চলতে পারে না বলে দুশ্চিন্তায় ভোগে। ভাবে তারা হয়তো সঠিক পরিমাণ পানি পান করছে না, হয়তো পানি স্বল্পতায় ভুগছে। বাস্তবতা হচ্ছে, বেশিরভাগ মানুষ তার শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পানি পান করে থাকে পানিসহ চা, কফি, স্যুপ, ফলের জুস কিংবা খাবারের জলীয় অংশ (ফুলকফি, বাঁধাকফি, বেগুন, পটোল, লাউসহ বেশিরভাগ সবজি ও ফলের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই পানি) হিসেবে। আমরা আসলে আমাদের প্রয়োজনীয় পানির ৬০ শতাংশ নিই বিশুদ্ধ পানি থেকে, ৩০ ভাগ পাই আর্দ্র খাবার থেকে ও ১০ শতাংশ পানি শরীরের ভেতরে বিভিন্ন প্রাণ-রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে উৎপন্ন হয়। এ যে, দিনে ৮ ঢ ৮ বা ৬৪ আউন্স পানি পানের বিষয়টি, আসলে একটি ভ্রান্ত ধারণা। এ ধারণাটি সম্ভবত ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন বোর্ডের একটি রেকমেন্ডেশনের ভুল ব্যাখ্যা থেকে এসেছিল। এখানে বলা হয়েছিল যে প্রতি ক্যালরি খাবারের (যে পরিমাণ খাবার থেকে এক ক্যালরি শক্তি উৎপন্ন হয়) জন্য একজন ব্যক্তির এক মিলি. পানির প্রয়োজন। তাহলে ১৯০০ ক্যালরির একটি গড় খাবারের জন্য প্রয়োজন ১৯০০ মিলি. বা ৬৪ আউন্স পানি। সুতরাং, মানুষ ধরে নিল যে দিনে একজন মানুষকে ৬৪ আউন্স বা প্রায় দুই লিটার পানি পান করতে হবে। কিন্তু প্রায় সব খাবারের মধ্যে যে কিছু অংশ পানির তাসহ অন্য পানীয় মানুষ হিসাবের মধ্যে নেয়নি। এ দৈনিক দুই লিটার পানি পানের ওপর হয়েছে কিছু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও। ২০০২ সালে আমেরিকান জার্নাল ও ফিজিওলজি ও ২০০৮ সালে আমেরিকান সোসাইটি অব নেফ্রোলজির জার্নালে প্রকাশিত পৃথক দুটি পেপারে দেখা যায় যে ৮ ঢ ৮ নিয়মটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তাৎপর্যপূর্ণ কোনো ভূমিকা নেই।
মজার বিষয় হচ্ছেÑসে ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন বোর্ড, যেটি এখন ন্যাশনাল একাডেমি অব মেডিসিনের একটি অংশ, বলছে দুই লিটার নয় বরং দিনে একজন গড় পুরুষের তিন দশমিক সাত লিটার, একজন গড় মহিলার দুই দশমিক সাত লিটার পানি প্রয়োজন। তবে হ্যাঁ, এ পানি মানে শুধু পানি নয় বরং খাবারের অংশ হয়ে থাকা পানি ও অন্য পানীয়র আওতায় পড়ে। তাছাড়া ব্যক্তিভেদে পানির প্রয়োজনীয়তাটা ভিন্ন হয় বলে দেখা যায়, বেশিরভাগ মানুষেরই এর (৩.৭ লি. ও ২.৭ লি.) থেকে অনেক কম পানি পান করলে চলে। যা-ই হোক না কেন, আবার তো সে হিসেবের মধ্যেই পড়ে গেলাম। যে হিসাব করে কূল পাওয়া যাবে না সে হিসাব বাদ দিয়ে আসুন শরীরের তৃষ্ণা কেন্দ্রের শরণাপন্ন হই।
শারীরবৃত্তীয় বহু কাজের কাজী হাইপোথ্যালামাসেই আছে ‘তৃষ্ণা কেন্দ্র’ নামে একটি অংশ যেটা দেহে পানির সুষম অবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি শরীরের তাপমাত্রা, ঘুম ও ক্ষুধারও সুষম অবস্থা নিশ্চিত করে। এ তৃষ্ণা কেন্দ্রটি সবসময় রক্তে লবণ ও অন্য উপাদানের ঘনত্ব ও সে সঙ্গে রক্তের মোট পরিমাণ ও চাপ মনিটর করে। যখন রক্তপাত, ঘাম বা ডায়রিয়ায় পানি স্বল্পতার কারণে রক্তচাপ কমে যায় এবং যখন অতিরিক্ত লবণ খাবার কারণে বা বিশেষ কোনো রোগের কারণে রক্তে সোডিয়ামের ঘনত্ব বেড়ে যায় তখন এ তৃষ্ণা কেন্দ্র স্নায়ুপথে পানি পানের জোড়ালো মেসেজ পাঠায় শরীরের অন্যান্য অংশে। তাদের সামগ্রিক কাজে আমরা তৃষ্ণা বোধ করি ও পানি পানে উদ্যোগী হই। সে সঙ্গে এটি পিটুইটারি গ্লান্ডকে কিছু হরমোন সিক্রেট করতে বলে যে হরমোনগুলো কিডনিতে পৌঁচ্ছে সেখানে ইউরিন থেকে পুনরায় পানি শোষণ করে রক্তস্রোতে নিয়ে আসে। এভাবে শরীর তার নিজস্ব মেকানিজম ব্যবহার করে প্রাকৃতিক ডাক (তৃষ্ণাবোধ) দেয়। আমরা যদি সে ডাকে সারা দিতে পারি তাহলে আর বাড়তি টেনশনের কিছু নেই। যদিও অনেক সময় কিছু মানুষ এ তৃষ্ণার বোধটি হারিয়ে ফেলেন। বিশেষ করে বৃদ্ধরা এ সমস্যায় পড়েন। এছাড়া কিছু ব্রেইন ইনজুরিও তৃষ্ণার সহজাত বোধটিকে নষ্ট করে ফেলে। তবে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের এত চিন্তা করে শরীরে স্ট্রেস হরমোন না বাড়ানোই ভালো। বরং কতটুকু পানি খাবেন তা আপনার তৃষ্ণাবোধ ও প্রস্রাবের রঙ ও গন্ধের ওপর ছেড়ে দিন।
জুঁই ইয়াসমিন, পুষ্টিবিজ্ঞান প্রশিক্ষক
সুত্র:শেয়ার বিজ