জরীফ উদ্দীন:
ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর। কোমল দুরন্ত মানবিক অনুভূতি। ভালোবাসা নিয়ে ছড়িয়ে আছে কত পৌরাণিক উপাখ্যান। সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি সর্বত্রই পাওয়া যায় ভালোবাসার সন্ধান। ভালোবাসার জন্য মানুষ মৃত্যুকে তুচ্ছ করে। রাজা সিংহাসন ত্যাগ করে হাসিমুখে প্রেমিকার হাত ধরে। আজকের এই পাথর সময়ে ঈর্ষা-বিদ্বেষ আর হানাহানির পৃথিবীতে ভালোবাসা প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করে চলেছে অমর্ত্যলোকের কাহিনী।
১৪ ফেব্রুয়ারিঃ
‘দোহাই তোদের, এতটুকু চুপ কর
ভালোবাসিরে, দে মোরে অবসর।’
আরে বাপু, প্রতিদিন এতো ব্যস্ত থাকি ভালোবাসার সময় পাই না। আজ একটু ভালোবাসব তারে নিয়ে ঘুরবো, তারে ফুল দিব, পাশে বসে ফুঁসকা-চটপটি -বাদাম খাবো মনের কথা প্রাণ খুলে কব। তাও দিবি না। বকবক থামা।
এই হচ্ছে আমাদের অবস্থা। আমরা সপ্তাহের ছয় দিন ভালো করে ভাত-ডাল-ভর্তা খেতে পারি না সপ্তাহের বাকি একদিন অর্থাৎ হাটের দিন মাংস রান্না হবে।
একবছরের ৩৬৪ দিন ভালোবাসা পূরণ হল না। ১৪ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক ভাবে ভালবাসতে হবে।
ভালোবাসার মোড়কে নষ্টামি আমদানিঃ
ভালোবাসা দিবস ভালবাসবেন ভালো কথা। একটু প্রশ্ন থেকে যায়, কাকে ভালবাসবেন? আজ সমাজে এটাই প্রচলিত, একজন ছেলে একজন মেয়ের সঙ্গে যে সম্পর্কে আবদ্ধ হয় তাই ভালোবাসা। এখানেই কি ভালোবাসা সীমাবদ্ধ? স্রষ্টা, তাঁর প্রেরিত মহামানব, শিক্ষক, বাবা, মা, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, বন্ধু, বান্ধবী, আত্মীয়, স্বজন এঁদের কে ভালোবাসতে হবে, তা নেই। মহা প্রেমিক/প্রেমিকা সেজে এখানে সেখানে ভালোবাসার নামে মেতে উঠবে অবৈধ খেলায়।
যেভাবে উৎপত্তি এই ভালোবাসার দিনটিরঃ
২৬৯ সালে ইতালির রোম নগরীতে সেন্ট ভ্যালেইটাইন’স নামে একজন খৃষ্টান পাদ্রী ওচিকিৎসক ছিলেন। ধর্ম প্রচার-অভিযোগে তৎকালীন রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাঁকে বন্দী করেন। কারণ তখন রোমান সাম্রাজ্যে খৃষ্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। বন্দী অবস্থায় তিনি জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এতে সেন্ট ভ্যালেইটাইনের জনপ্রিয়তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই দিন ১৪ই ফেব্রুয়ারি ছিল। অতঃপর ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ১ম জুলিয়াস ভ্যালেইটাইন’স স্মরণে ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন’ দিবস ঘোষণা করেন। খৃষ্টানজগতে পাদ্রী- সাধু সন্তানদের স্মরণ ও কর্মের জন্য এ ধরনের অনেক দিবস রয়েছে। যেমন: ২৩ এপ্রিল – সেন্ট জজ ডে, ১১ নভেম্বর – সেন্ট মার্টিন ডে, ২৪ আগস্ট – সেন্ট বার্থোলোমিজম ডে, ১ নভেম্বর – আল সেইন্টম ডে, ৩০ নভেম্বর – সেন্ট এন্ড্রু ডে, ১৭ মার্চ – সেন্ট পযাট্রিক ডে। পাশ্চাত্যের ক্ষেত্রে জন্মদিনের উৎসব, ধর্মোৎসব সবক্ষেত্রেই ভোগের বিষয়টি মুখ্য। তাই গির্জা অভ্যন্তরেও মদ্যপানে তারা কসুর করে না। মধ্য ফেব্রুয়ারিতে গ্রামের সকল যুবকরা সমস্ত মেয়েদের নাম চিরকুটে লিখে একটি পাত্রে বা বাক্সে জমা করত। অতঃপর ওই বাক্স হতে প্রত্যেক যুবক একটি করে চিরকুট তুলত, যার হাতে যে মেয়ের নাম উঠত, সে পূর্ণবত্সর ওই মেয়ের প্রেমে মগ্ন থাকত। আর তাকে চিঠি লিখত, এ বলে ‘প্রতিমা মাতার নামে তোমার প্রতি এ পত্র প্রেরণ করছি।’ বছর শেষে এ সম্পর্ক নবায়ন বা পরিবর্তন করা হতো। এ রীতিটি কয়েকজন পাদ্রীর গোচরীভূত হলে তারা একে সমূলে উত্পাটন করা অসম্ভব ভেবে শুধু নাম পাল্টে দিয়ে একে খ্রিস্টান ধর্মায়ণ করে দেয় এবং ঘোষণা করে এখন থেকে এ পত্রগুলো ‘সেন্ট ভ্যালেনটাইন’-এর নামে প্রেরণ করতে হবে। কারণ এটা খ্রিস্টান নিদর্শন, যাতে এটা কালক্রমে খ্রিস্টান ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। অন্য আরেকটি মতে, প্রাচীন রোমে দেবতাদের রানি জুনোর সম্মানে ১৪ ফেব্রুয়ারি ছুটি পালন করা হতো। রোমানরা বিশ্বাস করত যে, জুনোর ইশারা-ইঙ্গিত ছাড়া কোনো বিয়ে সফল হয় না। ছুটির পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি লুপারকালিয়া ভোজ উৎসবে হাজারও তরুণের মেলায় র্যাফেল ড্র’র মাধ্যমে সঙ্গী বাছাই প্রক্রিয়া চলত। এ উৎসবে উপস্থিত তরুণীরা তাদের নামাংকিত কাগজের স্লিপ জনসম্মুখে রাখা একটি বড় পাত্রে ফেলত। সেখান থেকে যুবকের তোলা স্লিপের তরুণীকে কাছে ডেকে নিত। কখনও এ জুটি সারা বছরের জন্য স্থায়ী হতো এবং ভালোবাসার সিঁড়ি বেয়ে বিয়েতে গড়াতো ওই সম্পর্ক। ওই দিনের শোক গাঁথায় আজকের এই ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’।
খৃস্টীয় এই ভ্যালেন্টাইন দিবসের চেতনা বিনষ্ট হওয়ায় ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার কর্তৃক ভ্যালেইটাইন উৎসব নিষিদ্ধ হয়। ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন উৎসব পিউরিটানরাও একসময় প্রশাসনিকভাবে এ দিবস উদযাপন করা থেকে বিরত থাকার জন্যে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। এছাড়া অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবস প্রত্যাখ্যাত হয়। বর্তমানকালে, পাশ্চাত্যে এ উৎসব মহাসমারোহে উদযাপন করা হয়। যুক্তরাজ্যে মোট জনসংখ্যার অর্ধেক প্রায় ১০০ কোটি পাউন্ড ব্যয় করে এই ভালোবাসা দিবসের জন্য কার্ড, ফুল, চকোলেট, অন্যান্য উপহারসামগ্রী ও শুভেচ্ছা কার্ড ক্রয় করতে, এবং আনুমানিক প্রায় ২.৫ কোটি শুভেচ্ছা কার্ড আদান-প্রদান করা হয়।
যে ভাবে এলো আমাদের দেশে এই দিনটিঃ
১৯৯৩ সালের দিকে আমাদের দেশে ভালোবাসা দিবসের আবির্ভাব ঘটে। সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব শফিক রেহমান পড়াশোনা করেছেন লন্ডনে। পাশ্চাত্যের রীতিনীতিতে তিনি ছিলেন অভ্যস্ত। দেশে ফিরে তিনিই ভালোবাসা দিবসের শুরুটি করেন। এ নিয়ে অনেক ধরনের মতবিরোধ থাকলেও শেষ পর্যন্ত শফিক রেহমানের চিন্তাটি নতুন প্রজন্মকে বেশি আকর্ষণ করে। সে থেকে এই আমাদের দেশে দিনটির শুরু।
তোরে ভালোবেসেরে বন্ধুঃ
আজ এই নষ্ট ভালোবাসার জন্য ভেঙ্গে যাচ্ছে কত সাজানো সুখের সংসার। অগনিত মেয়ে সম্ভ্রম হারিয়ে বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ। অসংখ্য ছেলে মেয়েদের প্রতারনায় স্বীকার হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার জগতে।
ভালোবাসা পাপ, ভালো না বাসা অন্যায়ঃ
আসুন আমরা অবৈধ ভালোবাসা থেকে বিরত থাকি যে ভালোবাসা প্রতিনিয়ত ডেকে আনে ধ্বংস। অার বৈধ ভালোবাসায় মেতে উঠি যা যার ফলে সমাজে শান্তির পায়রা উড়ে আসবে।
তথ্য সূত্রঃ উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট।