আব্দুল হাই রঞ্জুঃ
কৃষি ও শ্রমনির্ভর জেলা কুড়িগ্রাম। স্বাধীনতা-উত্তর এ জেলার কৃষিতে আশানুরূপ সমৃদ্ধি এলেও শ্রমনির্ভর শিল্প কারখানা স্থাপিত হয়নি। তবে কুড়িগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কের পাশে কুড়িগ্রাম টেক্সটাইল মিলটি স্থাপিত হওয়ায় এ জেলার শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছিল। এক সময় সম্ভাবনার এই মিলটির ভেঁপুর শব্দে এ এলাকার মানুষের ঘুম ভাঙত। ছিল কর্মচাঞ্চলতা, টেক্সটাইল মিলটিকে ঘিরে ব্যবসায়ীদেরও ছিল কর্মব্যস্ততা। কিন্তু মিলটির ভেঁপুর শব্দ বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। সরকারি উদ্যোগে মিলটি স্থাপিত হলেও লোকসানের মুখে এক পর্যায়ে বন্ধ করে দিয়ে বেসরকারি পর্যায়ে মিলটি লিজ দিলেও সে উৎপাদনের ধারাবাহিকতাও বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি। এ সুবিশাল এলাকাজুড়ে অবস্থিত মিলটি ভুতুড়ে অবস্থায় শুধু সময়ের সাক্ষী হয়েই দাঁড়িয়ে আছে। আদৌ মিলটি কি চালু হবে? এ এলাকায় নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্যদের সংসদে দাঁড়িয়ে মিলটি চালু করার দাবি অব্যাহত রাখা উচিত। অথচ বর্তমান সরকার পাট শিল্পের উত্থানে বন্ধ থাকা মিলগুলোকে একে একে চালু করছে। সোনালি আঁশ খ্যাত পাটের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে সরকার ‘মোড়কে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার’কে অনেক ক্ষেত্রেই বাধ্যতামূূলক করেছে। যদিও নানা প্রতিকূলের মুখে সে উদ্যোগ বাস্তবায়নে সরকার এখনও পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। আবার বন্ধ থাকা বস্ত্রকলগুলোকেও সরকার চালু করার পরিকল্পনা করেছে। কারণ একটাই তাহলো, কর্মসংস্থান বৃহৎ জনগোষ্ঠীর এই দেশে কর্মক্ষম হাতগুলোকে কাজ দিতে না পারলে বেকারত্বের হার ক্রমেই বাড়তে থাকবে। এ জন্য দেশীয়ভাবে শিল্প স্থাপন এবং বন্ধ থাকা শিল্পগুলোকে চালু করা একান্তই জরুরি। বিশেষ করে পশ্চাৎপদ কুড়িগ্রাম জেলায় শ্রমনির্ভর মানুষের সংখ্যা অনেক। যারা কৃষি সেক্টরে কাজ করে, তাদের সারা বছরের কর্মসংস্থান এ জেলায় হয় না। তারা কাজের সন্ধানে বাসে গাদাগাদি করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছোটাছুটি করেন। পাশাপাশি এ জেলার শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের কর্মক্ষেত্র নেই বললেই চলে। তারা কাজের অভাবে বসে অলস সময় কাটাতে বাধ্য হন। পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনীর লোক নিয়োগের সময় হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর ভিড়ে কুড়িগ্রাম মুখর হয়ে ওঠে। কিন্তু সবার ভাগ্যে চাকরি জোটে না। এ জেলার এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা কর্মসংস্থানের।
জেলাটি কৃষিনির্ভর হলেও কৃষিভিত্তিক শিল্প কলকারখানা তেমন একটা গড়ে ওঠেনি। আলু সংরক্ষণের উপযোগী কয়েকটি হিমাগার ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চালকল শিল্পই এ জেলায় কৃষিভিত্তিক শিল্প। বর্তমান চালকল শিল্পে হাসকিং নামে প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হয়েছে। এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত হাজার হাজার মানুষকে কাজ হারাতে হয়েছে; যাদের এখন দিন চলে অতি মানবেতর পরিবেশে। আবার এই হাসকিং শিল্পের ওপর বিনিয়োগকৃত ব্যাংকগুলোর ঋণের অর্থ আদায় এখন তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এটা স্পষ্ট, উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ওপর ভর করে গড়ে ওঠা কৃষিভিত্তিক শিল্প বিকাশের বদলে সংকুচিত হলে সে দায় গোটা অর্থনীতিকে পর্যুদস্ত করে। ফলে আমদানি-নির্ভরতা বাড়ে আর আমদানি-নির্ভরতা একটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে বড় বাধা। এ জন্য দেশি শিল্প-কলকারখানা স্থাপন করে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে না পারলে উপরিভাবে হয়তো চাকচিক্য সৃষ্টি করা সম্ভব হবে; কিছু সমৃদ্ধি অর্থনীতি আশা করা হবে বাতুলতাতুল্য। দেশি শিল্প-কলকারখানা স্থাপনের সংকট শুধু কুড়িগ্রামেই নয়। এ সংকট কমবেশি গোটা দেশেই প্রকট।
জীবন-জীবিকার তাগিদে কুড়িগ্রাম জেলার বেকার জনগোষ্ঠীকে শুধু কাজের সন্ধানে দেশ কিংবা বিদেশে যেতে মরিয়া হয়ে উদ্বিগ্ন সময় অতিবাহিত করতে হয়। কিন্তু কুড়িগ্রাম জেলায় কৃষিভিত্তিক বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প স্থাপনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এ জেলায় ধান, পাট, ভুট্টা, কলাই, সরিষার পাশাপাশি যথেষ্ট পরিমাণ সবজির চাষাবাদ হয়। এসব উৎপাদিত কৃষিপণ্য সংরক্ষণ উপযোগী শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা সম্ভব হলে, একদিকে চাষিরা যেমন উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন; অন্যদিকে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করাও সম্ভব হবে। এ জন্য এ জেলায় কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের দিকে সরকারকে বিশেষভাবে নজর দেওয়া উচিত। শুধু সবজি সংরক্ষণ উপযোগী শিল্প প্রতিষ্ঠানই নয়, সোনালি আঁশখ্যাত পাট ও পাটখড়ির ওপর শিল্প স্থাপন করার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সে ধরনের উদ্যোগ কখনই নেওয়া হয়নি। অথচ পাট চাষাবাদ করে সে পাটের ন্যায্যমূল্যের অভাবে পাটচাষিরা পাট চাষ করা ছেড়েই দিয়েছিলেন। কয়েক বছর ধরে পাটের ন্যায্যমূূল্য নিশ্চিত হওয়ায় এখন পাটের যথেষ্ট চাষাবাদ হচ্ছে। কৃষকের স্বার্থ উপযোগী সরকারি নীতিমালা গ্রহণ এবং তার সফল বাস্তবায়নের ওপর সুফল অনেকাংশেই নির্ভরশীল। এখন ধান-পাটের পাশাপাশি এ জেলা এবং পার্শ্ববর্তী লালমনিরহাট জেলায় ব্যাপকভাবে ভুট্টার চাষাবাদ হচ্ছে। কিন্তু ভুট্টাচাষিরা ভুট্টার উপযুক্ত মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ ভুট্টা পোলট্রি শিল্পের অনুকূলে উপযোগী একটি পণ্য। এ অঞ্চলে মুরগির খাদ্য উৎপাদনে সরকারিভাবে শিল্প স্থাপন করা হলে পোলট্রি শিল্প বিকাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। সবদিক বিবেচনায় নিয়ে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যেমন জরুরি, তেমনি স্থাপিত কুড়িগ্রাম টেক্সটাইল মিলটি চালু করলে বিপুল পরিমাণ মানুষের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে। কুড়িগ্রাম জেলাবাসীর প্রাণের দাবি, এ জেলায় গড়ে ওঠা একমাত্র শিল্প প্রতিষ্ঠান কুড়িগ্রাম টেক্সটাইল মিলটি চালু করার। সে আকাঙ্ক্ষার কতটুকু বাস্তবে প্রতিফলন হবে, তা নির্ভর করবে সরকারের সদিচ্ছার ওপর। শুধু টেক্সটাইল মিলটিই নয়, কুড়িগ্রামে ‘শিল্প জোন’ স্থাপন করা সম্ভব হলে তুলনামূলক কম শ্রমমূল্যের কারণে বৃহৎ এবং মাঝারি শিল্প বিকাশের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
সুত্রঃ সমকাল