নিউজ ডেস্কঃ
উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের গোড়াই রঘুরায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নেয়ামুল হকের বিরুদ্ধে জাতীয় দিবস পালনে অনীহা, অনিয়ম এবং দুর্নীতি ও যাচ্ছেতাইভাবে বিদ্যালয় পরিচালনার গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন এবং একই সাথে স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ নিজ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের কাছে ঘটনা তদন্তের জন্য আবেদন করেন। এর ফলশ্রুতিতে দুর্গাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা খুঁজে পেয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার বরাবর এই প্রধান শিক্ষকের অপসারণ চেয়ে পৃথক লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। কিন্তু জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার কর্তৃক তাৎক্ষনিক কোন ব্যবস্থা না পেয়ে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি ঘটনাটি স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন। পরবর্তীতে তিন জন সাংবাদিক সরেজমিনে দেখতে ও জানতে বিদ্যালয়ে গেলে প্রধান শিক্ষক কর্তৃক হয়রানির স্বীকার হন। সেখানে তিন সাংবাদিককে একটি কক্ষে তালাবদ্ধ করলে স্থানীয় ইউপি সদস্য ও জনগণের হস্তক্ষেপে তালা খুলে দিয়ে ঘটনার জন্য ক্ষমা চান প্রধান শিক্ষক নেয়ামুল হক। এ ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে আলোড়ন উঠেছে এবং স্থানীয় জনগণ ও আওয়ামী লীগে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।
(দুর্গাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কর্তৃক পাঠানো লিখিত অভিযোগ)
জনপ্রিয় অনলাইন মাধ্যম ব্রেকিং নিউজ, সময়ের কণ্ঠস্বর, অল বাংলা নিউজ সহ প্রায় ১৫টি অনলাইন পোর্টাল এবং যুগের আলো সহ কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের সূত্রে এসব জানা গেছে। উলিপুর ডট কমের নিজস্ব অনুসন্ধানেও বেরিয়ে এসেছে ঘটনার সত্যতা। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষাব্যবস্থা ভেস্তে যেতে বসেছে বলে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি ও স্থানীয়দের পক্ষ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিদ্যালয়টিতে সঠিকভাবে জাতীয় বিভিন্ন দিবস পালন না করার গুরুতর অভিযোগও পাওয়া গেছে। এছাড়া বিদ্যালয়ে সময়মত শিক্ষকদের উপস্থিতি ও সঠিকভাবে পাঠদান না করার ক্ষেত্রেও প্রধান শিক্ষকের গোয়ার্তুমি, গড়িমসি ও অনাগ্রহকেই দায়ী করছেন স্থানীয়রা। এ অবস্থায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর তোপের মুখে পড়েছেন প্রধান শিক্ষক নেয়ামুল হক।
জানা গেছে, প্রায় আড়াই বছর আগে ২০১৪ সালের ১২ মে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর থেকে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিকে তোয়াক্কা না করে মনগড়াভাবে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন ওই শিক্ষক। স্থানীয় নানা মহলের প্রশয়ে এসব করেও বারবারই পার পেয়ে গেছেন তিনি।
এরই ধারাবাহিকতায় এ বছর ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বিদ্যালয়টির পক্ষ থেকে কোনও ধরনের কর্মসূচি পালন করা হয়নি। এনিয়ে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে এলাকাবাসী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে।
সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেখানে বিজয় দিবসের নানামুখি কর্মসূচি পালিত হয়েছে সেখানে গোড়াই রঘুরায় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কেন ১৬ ডিসেম্বরে কোনও অনুষ্ঠানাদি কিংবা কোনও উদযাপন হয়নি? এমন প্রশ্নে স্বাভাবিকভাবেই খাদে পা পড়েছে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক নেয়ামুল হকের।
বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, সহ-সভাপতি ও স্থানীয় জনগণের সাথে কথা বলে জানা গেছে – ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে সকাল ১১টা পর্যন্ত বিদ্যালয় বন্ধ থাকতে দেখে ম্যানেজিং কমিটির পক্ষে কয়েকজন ব্যক্তি প্রধান শিক্ষক নেয়ামুল হকের সাথে যোগাযোগ করেন এবং বিজয় দিবস পালনের বিষয়ে জানতে চান। বারবার যোগাযোগের পর তিনি একা এসে নিজ হাতে পতাকা উত্তোলন করেন। বিজয় দিবসের কোন প্রকার ভাবগাম্ভীর্য দেখতে না পেয়ে প্রধান শিক্ষকের কৈফিয়ত চাইলে তিনি গালাগালি ও দুর্ব্যবহার করেন। এ সময় উপস্থিত ক্ষুব্ধ জনগণ ঘটনাস্থল থেকেই জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে অবহিত করেন। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সেসময় কথা বলতে চাইলে প্রধান শিক্ষক অস্বীকৃতি জানান।
এ নিয়ে উলিপুর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি শামসুল হক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার বরাবর পৃথক লিখিত অভিযোগপত্রে বিজয় দিবস পালনে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নেয়ামুল হক ওরফে সোনার’র গড়িমসি ও অবমাননার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। এ নিয়ে গত ক’দিন ধরে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাও।
(বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি কর্তৃক পাঠানো লিখিত অভিযোগ)
এলাকাবাসী সূত্রে আরও জানা গেছে, শুধু এবারের বিজয় দিবসই নয়, জাতীয় দিবস, মা এবং অভিভাবক সমাবেশ, ছাত্র-ছাত্রী উদ্বুদ্ধকরণেও বিদ্যালয়টি কোনও সভা-সমাবেশ করে না। এছাড়া প্রধান শিক্ষক নেয়ামুল হকসহ অন্যান্য সহকারী শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে সঠিক সময়ে উপস্থিতও হন না। একইসঙ্গে প্রধান শিক্ষক নেয়ামুল হক সম্প্রতি স্লিপ প্রকল্পের ৪০ হাজার টাকায় মাত্র একটি নামফলক ও নামেমাত্র একটি পতাকা স্তম্ভ স্থাপন করে অবশিষ্ট টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলেও এলাকাবাসীর অভিযোগ।
সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে গত ২১ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, প্রধান শিক্ষক নেয়ামুল হক বিদ্যালয়ে উপস্থিত নেই। সহকারী শিক্ষক ফরিদা ইয়াসমিন, জীবুন্নাহার, আয়ভান ও মাহমুদা বেগম অফিস রুমে বসে খোশগল্প করছেন। পাশে আরডিআরএস নামের বেসরকারি সংস্থার কর্মী কামরুন নাহার তৃতীয় শ্রেণির খাতা মূল্যায়ন করছেন। শ্রেণীকক্ষগুলোতে শিক্ষার্থীরা হই-হুল্লোড় করছে। চোখে দেখলে মনে হবে শিক্ষার নামে যেন এখানে এক গোড়ায় প্রকৃতির শাসন চলছে।
এ সময় কথা হয় ওই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আঃ লতিফ মিয়ার সাথে। তিনি সাংবাদিকদেরকে জানান, বিদ্যালয়টিতে একজন পুরুষ শিক্ষক বাদে সকলে মহিলা। আশ্চর্যজনকভাবে প্রত্যেক মহিলা শিক্ষককে একইসাথে মাতৃত্বকালীন ছুটি দিয়ে বিদ্যালয়কে প্রায় অকার্যকর করা হয়েছিল। এবং বর্তমানে প্রত্যেক মহিলার নবজাতক শিশু রয়েছে। তারা তাদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এতে শিক্ষার্থীরা পাঠগ্রহণ থেকে পিছিয়ে পড়ছে।
এদিন গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতির খবর পেয়ে এলাকাবাসী ওই বিদ্যালয়ে এসে প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তুলে ধরেন। এর মধ্যে স্থানীয় ৫নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ওই বিদ্যালয়ের সহ-সভাপতি সামছুল হক গত ১৬ ডিসেম্বর বিদ্যালয়টিতে বিজয় দিবস উপলক্ষে কোনও কর্মসূচি পালিত না হওয়ার স্বচিত্র ভিডিও উপস্থাপন করেন।
এ ব্যাপারে পার্শ্ববর্তী ৪নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব মোস্তাফিজার রহমানের কথাতেও ক্ষোভ ছিল লক্ষণীয়। তিনি ব্রেকিংনিউজকে বলেন, ‘যারা বিজয় দিবসকে অস্বীকার করে পালন করে না, তারা স্বাধীনতাবিরোধী। তারা সরকারি চাকুরি করে কীভাবে? তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তি হওয়া দরকার।’ এ সময় ৫নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মাইদুল ইসলাম স্লিপ প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করারও অভিযোগ করেন।
আক্তারুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক বাসিন্দাসহ আরও অনেকের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষক নেয়ামুল হকসহ সহকারী কোনও শিক্ষিকাই সঠিক সময়ে বিদ্যালয়ে আসেন না। তারা মনগড়া আসা-যাওয়া করেন। এসব বিষয়ে বারবার স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি প্রধান শিক্ষকসহ সকল শিক্ষিকাকে সর্তক করার চেষ্টা করলেও শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ কমিটির নির্দেশনা অমান্য করেই যাচ্ছেন দিনের পর দিন।
(স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ কর্তৃক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগকে পাঠানো লিখিত অভিযোগ)
এক পর্যায়ে সভাপতি সাংবাদিকদের বিদ্যালয়ের অফিস কক্ষে নিয়ে গেলে প্রভাবশালী শিক্ষিকা মাহমুদা বেগম বাকবিতণ্ডা শুরু করেন। এর এক পর্যায়ে তিনি তিন গণমাধ্যমকর্মী, বিদ্যালয়ের সভাপতি, সহ-সভাপতি ও উপস্থিত কয়েকজনকে কক্ষের ভিতরে রেখে দেড় ঘন্টা তালাবন্দি করে রাখেন।
খবরটি ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় ইউপি সদস্য মাইদুল ইসলামসহ এলাকাবাসী ছুটে এসে অফিস কক্ষের তালা খুলে দেন। তালা খুলে দেয়ার পর ১২টা ৩৫ মিনিটে প্রধান শিক্ষক নেয়ামুল হক অফিসে এসে বিষয়টির দায় স্বীকার করেন এবং এ জন্য সকলের কাছে ক্ষমা চান।
দুর্নীতি অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার ব্যাপারে প্রধান শিক্ষক নেয়ামুল হক আংশিক সত্যতা স্বীকার করে ব্রেকিংনিউজকে বলেন, ‘আমি যা কিছু করেছি সব সরকারি বিধি অনুযায়ী করেছি। এ উপজেলায় ২৬৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এ রকম অনিয়ম দুর্নীতি প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে রয়েছে। আমি ফেরেশতা না, ভুল আমারও হতে পারে।’ তিনি বারবারই শুধু বলেন, ‘আমরা বিজয় দিবস পালন করেছি। সকালেই বিদ্যালয়ের পতাকা উত্তোলন করেছি। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা হয়েছে।’
তবে ‘জাতীয় দিবস হিসেবে ১৬ই ডিসেম্বর বিদ্যালয়ে কেন সকাল ১১টা পর্যন্ত অনুপস্থিত ছিলেন এবং বাকি শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও ম্যানেজিং কমিটির কাউকে ডাকেননি’, এ প্রশ্নের জবাব তিনি বারবারই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার ও ক্লাস্টার ট্রেইনার মোঃ জাহিদুল ইসলাম ফারুকের সঙ্গে। তিনিও বিজয় দিবস পালন না হওয়া সংক্রান্ত অভিযোগ রহস্যজনকভাবে এড়িয়ে শুধু বলেন, ‘অভিযোগ পেয়েছি। মূল ঘটনা হলো ওই প্রতিষ্ঠানে পিয়ন নিয়োগকে কেন্দ্র করে এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।’
এ ব্যাপারে কথা বলতে উলিপুর ডট কমের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল প্রধান শিক্ষক নেয়ামুল হকের সাথে। তিনি মোবাইলে কথা বলতে ইতস্তত বোধ করেন এবং দুই দিন পর দেখা করতে চান। কিন্তু চার দিন অতিবাহিত হলেও যোগাযোগ করেননি।
উলিপুর ডট কমের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বপন কুমার রায় চৌধুরীর সাথেও। তিনি বলেন, অভিযোগকারী বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে মোবাইল ফোনে অবহিত করেছে। লিখিত অভিযোগও পেয়েছি। অভিযোগের ভিত্তিতে উপজেলা শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে তদন্ত কমিটি করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উলিপুর উপজেলা শিক্ষা অফিসারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনিও জেলা শিক্ষা অফিসারের কথার পুনরাবৃত্তি করেন।