আব্দুল মালেকঃ
কুড়িগ্রামে এ বছর ৩ দফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। সরকারের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় এসব মানুষ এখন নিদারুণ কষ্টে রয়েছে। অন্যদিকে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ সংস্কার না হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় বেহাল অবস্থার পাশাপাশি শিক্ষা কার্যক্রমেও মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে। বন্যার পানিতে বিভিন্ন এলাকায় দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় বিপুল পরিমান জমি অনাবাদি রয়েছে। এদিকে জেলার বিভিন্ন এলাকায় গবাদি পশুর খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারন করেছে। পাশাপাশি চালের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার গুলো নানামূখি সংকটে এখন দূর্বিসহ জীবন কাটাচ্ছে। সরকারি ও বে-সরকারি ভাবে রিলিফ কার্যক্রম চালানো হলেও জনপ্রতিনিধিদের পক্ষপাতমূলক আচরণের কারনে অনেক ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার এসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থেকেই যাচ্ছে। সব মিলিয়ে জেলার জন-জীবনে স্থবিরতা বিরাজ করছে।
উলিপুর উপজেলার বুড়াবুড়ি, হাতিয়া, বেগমগঞ্জ, সাহেবের আলগা, দলদলিয়া, থেতরাই ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে দীর্ঘ সময় বন্যার পানিতে ডুবে থাকায় অনেক এলাকার আবাদি জমি অনাবাদি পড়ে আছে। ব্রহ্মপূত্র নদ বিচ্ছিন্ন চর গুজিমারীর খোকা মিয়ার ৩ একর, মজিবর রহমানের ৫ একর এবং আব্দুল হক নামের এক কৃষকের ১০ একর জমির রোপা আমন চারা ২ দফা বন্যার পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। তাদেরকে এখন পর্যন্ত কৃষি পূনঃবাসনের আওতায় না আনায় পরিবার গুলো অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। এমন হাজার হাজার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার জেলার বন্যা কবলিত এলাকায় দেখা গেছে। এছাড়াও পানির তোড়ে ভেঙ্গে যাওয়া ঘর-বাড়ি গুলো এখনও মেরামত করতে পারেনি ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার গুলো। হাতিয়া ইউনিয়নের কুমার পাড়ার কাঞ্চনমালা (৩৮), মালতি রবিদাস (৪০), আজিরন বেগম (৫২), মহিলা বেগম(৪৫), কদমতলা গ্রামের আবুল হোসেন(৪৮), স্বরবালা (৪৫), ছবিরন নেছা (৫০), অনন্তুপুর ঘাটে অন্যের বাড়িতে আশ্রিত কফুল্লা আলী (৭০), অন্যের জমিতে আশ্রিত পালপাড়ার ভিক্ষুক ছবিতারাণী দাস(৫২), তাঁতীপাড়ার বৃন্দেশরীসহ অনেকেই কোন রকম ভাঙ্গাচুড়া দোচালার ভিতর পলিথিন দিয়ে বসবাস করতে দেখা গেছে।
হাতিয়া ইউনিয়নের চিড়াখাওয়ার পাড় গ্রামের কৃষক গোলজার হোসেন জানান, তার ৩ একর জমিতে লাগানো রোপা আমন চারা প্রথম দফার বন্যায় ডুবে নষ্ট হয়ে যায়। অনেক কষ্টে চড়া দামে চারা সংগ্রহ করে আবারও ১ একর জমিতে চারা লাগান। দ্বিতীয় দফা বন্যায় তা আবারও নষ্ট হয়ে গেলে আর চারা লাগানো সম্ভব হয়নি। গো-খাদ্য সংগ্রহ করার উপায় না থাকায় তার ২ টি গরু বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। চাল কিনে ভাত খাব সে উপায়ও নাই। জমিজমা থাকায় সরকারি সাহায্যের তালিকায় নামও দেয় না চেয়ারম্যান মেম্বারারা। তারা শুধু নদী অববাহিকার মানুষজনকেই রিলিফ দিচ্ছে। একই গ্রামের আজাহার আলী ,জয়নাল আবেদীন, নয়া গ্রামের আমিনুল ইসলাম সিও, রহমান মাষ্টারসহ কথা হয় অনেকের সাথে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের এসব মানুষ জানান, জমি আছে, আবাদ নাই, রিলিফ পাব সে আশাও নাই।
ব্রহ্মপূত্র নদ তীরবর্তি অনন্তপুর বাজার এলাকায় কয়েক বছর আগে বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার পর সেখানে আর নতুন করে বাঁধ নির্মাণ না করায় প্রতি বছর লোকালয়ে বন্যার পানি ঢুকে বিস্তৃর্ণ এলাকার হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হচ্ছে। এসব এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন জনপ্রতিনিধিদের পক্ষপাত মুলক আচরণের কারনে সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত থাকছেন বলে অভিযোগ করেন তারা। বিশেষ করে, উলিপুর উপজেলার হাতিয়া, ধামশ্রেনী, তবকপুর ও চিলমারী উপজেলার রানীগঞ্জ, জোড়গাছ, থানাহাট ইউনিয়নসহ বেশকিছু এলাকায় ব্রহ্মপূত্র নদের বন্যার পানি ঢুকে তা দীর্ঘস্থায়ী জলবদ্ধতার সৃষ্টি করে। ফলে জেলার ব্রহ্মপূত্র ,ধরলা ও তিস্তা নদী অববাহিকার বাইরে বাঁধের ভিতর হাজার হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন, রবিশষ্যসহ বিভিন্ন ফসলাদি পানিতে ঢুবে পঁচে গেছে। বন্যার পর এ অঞ্চলের কৃষকরা ঘুরে দাড়াতে চাইলেইও মাঠের অবশিষ্ট রোপা আমন ক্ষেতে গোড়া পঁচা ও পাতা মোড়ানো পোকার ব্যাপক আক্রমন হয়েছে। ঔষধ প্রয়োগ করেও কোন রকম প্রতিকার না পাওয়ায় শংকিত কৃষকরা। অনেক কৃষকের অভিযোগ কৃষি বিভাগের কোন কর্মকর্তাই মাঠে পাওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি জেলার ছোট বড় কাঁচাবাজার গুলোতে এর প্রভাব পড়ছে। হাট-বাজারে চালের পাশাপাশি গো-খাদ্যও অগ্নিমূল্যে বিক্রি হচ্ছে। খাদ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকারি ভাবে ওএমএস এর মাধ্যমে চাল বিতরণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। জেলার বিভিন্ন পয়েন্টে ডিলাররা ১০ টার মধ্যে চাল বিক্রি শেষ করায় অনেকে না পেয়েই ফিরে যাচ্ছে। ফলে জেলা জুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক বন্যায় ২টি পৌরসভাসহ ৬০টি ইউনিয়নের প্রায় ৯ লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্পূর্নভাবে ৬ হাজার ১’শ ৭৪ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৮’শ ৮৫ পরিবার। এদের মধ্যে ২ হাজার ১’শ ৮৭ টি বাড়ি সম্পূর্ণ রুপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আংশিক ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা ১ লাখ ৪৬ হাজার ১’শ ৯৩টি পরিবারের বাড়ি। বন্যার পানির তোড়ে হাঁস-মুরগি, গরু, ছাগলসহ ৩ হাজার ১’শ ৪৪ টি গবাদি পশু ভেসে গেছে। ১৭ হাজার ৪’শ ৮০ হেক্টর জমির বীজতলাসহ রোপা আমন ক্ষেত সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২’শ ১ টি ব্রীজ কার্লভাটসহ ১ হাজার ৯’শ ৪৭ কিলোমিটার সড়ক ও ২’শ ৪৯ টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ ৪’শ ৪৩ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোঃ ফেরদৌস খাঁন এর সাথে ফোনে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। কুড়িগ্রাম খামার বাড়ির উপ-পরিচালক মকবুল হোসেন জানান পোকা খেলেও উৎপাদনে কোন ঘাটতি হবেনা। মাঠে কৃষি বিভাগের কোন লোককে কৃষকরা পাচ্ছেনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন আমি অতিশীঘ্রই ব্যবস্থা নিচ্ছি।