মাঈদুল ইসলামঃ
বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগানো পা চালিত নলকূপ বা ঢেঁকিকলের আবিষ্কারক (ইংরেজিতে Treadle Pump বলা হয়) উলিপুরের কৃতি সন্তান নরেন্দ্রনাথ দেব আর নেই। গতকাল শুক্রবার রাত ১০:২০ মিনিটে উলিপুরস্থ জোদ্দারপাড়া গ্রামে তাঁর নিজ বাসভবনে তিনি পরলোকগমন করেন। মৃত্যকালে তার বয়স ছিলো ৯০ বছর। তিনি একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাঁর হাতেই কৃষিক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনার মত বেশ কয়েকটি যন্ত্রের আবিষ্কার ঘটে।
নরেন্দ্রনাথ দেব ১৯২৭ সালের ২১ শে জুন উপজেলার তবুকপুর ইউনিয়নের কাশিম বাজার গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। ১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে আর লেখাপড়া করতে পারেননি। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর কাঁঠালবাড়ী হাইস্কুলে চাকুরী শুরু করেন এবং এর ২ বছর পর কাশিম বাজার মহারাজা এস্টেটে ৩ বছর চাকরি করেন। কিন্তু আবিষ্কারের নেশা চাকরির ধরাবাঁধা নিয়মে আবদ্ধ রাখতে পারেনি তাঁকে। এ সময় ফটোগ্রাফির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। পরে করেন বিড়ির ব্যবসা। বিড়ির লেবেল ছাপানোর জন্য আবিষ্কার করেন কাঠ দিয়ে তৈরি পা-চালিত প্রেস। এরপর উলিপুর বাজারে ছোট একটি লেদ মেশিন বসিয়ে শুরু করেন নতুন ব্যবসা। পরে কাঠের উন্নত ট্রেডল প্রেস তৈরি করে বাজারজাতও করেন। কিছুদিন বাদে পরীক্ষামূলকভাবে স্টিম ইঞ্জিন উদ্ভাবন করে চমকে দেন। ধান সিদ্ধ, ধান ভানাসহ নানা কাজে ব্যবহার করা যায় এই ইঞ্জিন। তাঁর পরিকল্পনা ছিল সৌরশক্তি ব্যবহার করে ইঞ্জিনটি চালানো। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা বেশিদূর এগোয়নি।
তাঁর অন্যান্য আবিষ্কারের মধ্যে ছিল দোতলায় পানি তোলার জন্য কম খরচে মোটরচালিত টিউবওয়েল, হুইল ও টিন দিয়ে বার্লি তৈরির মেশিন, ডাল ভাঙ্গার, গমডাঙ্গা মেশিন, অটোমিল ইত্যাদি।
গ্রামের মহিলারা কলসিতে জল ভরে জমিতে দেয় তা দেখে বাঁশের পাইপ, ওয়াশার ও কাস্ট আয়রনের সিলিন্ডার দিয়ে তৈরী করেন ঢেঁকিকল (ট্রেডল পাম্প)। ১৯৭৭ সালে সেই ঢেঁকিকল উদ্ভাবনের জন্য রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত হন এবং একটি বেসরকারী সংস্থার ব্যয়ে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, নেপালসহ একাধিক দেশ ভ্রমন করেন। তার আবিষ্কৃত পা চালিত নলকূপ দেখার জন্য ১৯৭৯ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান উলিপুর এসেছিলেন। ১৯৯১ সালে সোনারগাঁও হোটেলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাঁকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেন। এছাড়া ড. ইউনুছ, বেলাল বেগ, গুনারবার্গ সহ শতাধিক খ্যতিমান ব্যাক্তি তার ঢেঁকিকল দেখতে উলিপুর এসেছিলেন। এমনকি তার আবিস্কৃত ঢেঁকিকল নিয়ে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ “জননী” নামক একটি নাটকও তৈরী করেন।
১৯৯১ সালে ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এন্টারপ্রাইজের (আইডিআই) সহায়তায় অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ১৪ দিনের সফরে ভিয়েতনাম যান নরেন্দ্রনাথ দেব। তাঁর ওপর বেশ কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়। এর একটি নির্মাণ করেন ভারতের প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নলিনী সিং।
বেসরকারি কয়েকটি সংগঠনের কাছ থেকেও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে আইডিআইয়ের লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, কুড়িগ্রামের সলিডারিটি, প্রবীণ হিতৈষী সংঘ এবং ঢাকার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দেওয়া সম্মাননা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০০০ ও ২০০৩ সালে জেলা প্রশাসক স্বাধীনতা পদকের জন্য তাঁকে মনোনীত করলেও শেষ পর্যন্ত তা পাননি।
তাঁর আবিষ্কারের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কিংবা মেধাস্বত্ব আইনে স্বীকৃতি মেলেনি নরেন্দ্রনাথ দেবের ভাগ্যে। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও স্বত্ব না থাকায় তাঁর আবিষ্কৃত ঢেঁকিকল বিভিন্ন দেশের কোম্পানি নানা নামে তৈরি করে বাজারজাত করছে। পেটেন্ট করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন তিনি। অনেক দূর এগিয়ে গেলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সফল হননি।
উলিপুরের এই প্রাণ পুরুষ ৯০ বছর কর্মময় জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে পরপারে চলে যাওয়ায় তার পরিবারসহ উলিপুরবাসী গভীরভাবে শোকাহত। তিনি স্ত্রী, ৪ ছেলে, ২ কন্যা, নাতি-নাতনি, আত্মীয়স্বজনসহ অনেক গুনগ্রাহী রেখে গেছেন। তার পরলোকগমনে গভীর শোক প্রকাশ করে পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য আমজাদ হোসেন তালুকদার, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হায়দার আলী মিঞা, পৌর মেয়র তারিক আবুল আলা, উপজেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক এম এ মতিন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতি শিউলী, সাধারন সম্পাদক গোলাম হোসেন মন্টু, উলিপুর ডট কমের সম্পাদক প্রকৌশলী রূপম রাজ্জাক ও নির্বাহী সম্পাদক আঃ ছোবহান জুয়েল, উলিপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু সাঈদ সরকার, সাধারন সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম সরদার, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল মালেকসহ প্রেসক্লাবের সকল সদস্যবৃন্দ।