জরীফ উদ্দীন
প্রশাসনের নাকের ডগায় এলাকাবাসীর স্বার্থপরতায় অযত্ন অবহেলা ও ভুয়া মামলায় কালের গহ্বরে বিলিন হয়ে যাচ্ছে কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার ধরণীবাড়ী ইউনিয়নের মুন্সীবাড়ী।
উপজেলা সদর থেকে উত্তরপূর্বে প্রায় ২ কি.মি. দূরে ৩০ একর জমির মাঝে চন্দ্রবিন্দু ন্যায় অবস্থিত মুন্সীবাড়ী দালানবাড়ি। বর্তমানে বাড়ীটি ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহিত হয়ে আসছে। বাকী ঘরগুলো পরিত্যক্ত। বাড়ীর মূল ভবনটি ছাড়াও বাড়ীর ভিতরে আছে একটি খোলা মঞ্চ, একটি তুলসী পাঠ, স্নানাগার, বাড়ীর এক কোণে রয়েছে শৌচাগার। স্নানাগারের ভিতরে একটি কূপ যা ভরে গেছে মাটি দ্বারা, পরিষ্কার পরিছন্নতার অভাবে ভরে গেছে জঙ্গলে। সেখানে খুব আয়েশে থাকে গেছো শামুক। বাড়ীটির পিছনের লাগোয়া মন্দিরটিতে বাজে না কাঁসার ঘণ্টা, হয়না পূজা অর্চনা। বাড়ির সামনের পুকুরটা আজ শেওলায় ভরে গেছে নেই আগের সেই সান বাঁধানো ঘাট। একদিন যে বট-পাকুড় গাছকে নিঃসন্তান মুন্সী বিয়ে দিয়েছিল তা আজ বাড়ীর প্রবেশ পথে অন্য গাছের ভিরে দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। বাকি জমিতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা, ঘর-বাড়ি, বাজার। দখলে গেছে প্রভাবশালীদের হাতে। সিংহভাগ জমি ব্যবহিত হচ্ছে আবাদি হিসেবে।
এলাকাবাসী ও স্থানীয় সাহিত্য সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিরা চায় জমিদার আমলের তৈরি মুন্সীবাড়ী সংস্কার করে গড়ে তোলা হউক একটি যাদুঘর। যেখানে ‘রাতে বসতবাড়ি আর দিনে জাদুঘর’ নামে পরিচিত আব্রাহাম লিংকন তার নিজ বাড়িতে গড়ে তুলতে পারেন ‘উত্তরবঙ্গ জাদুঘর’, এবং ভাওয়াইয়া একাডেমী, উলিপুর, কুড়িগ্রামের সামান্য যায়গাতে গড়ে উঠতে পারে কছিম উদ্দীন লোকশিল্প সংগ্রহশালা সেখানে মুন্সীবাড়ীর অট্টালিকা ও ৩০ একর যায়গায় কেন গড়ে উঠতে পারে না একটি যাদুকর? আজ প্রশ্ন সুধীজনের।
এখানে একটি সমৃদ্ধিশালী জাদুঘর হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, যেখানে স্থান পাবে গ্রামীণ লোকজ সামগ্রী ছাড়াও বাহারবন্দ ও ভিতরবন্দের ধ্বংসাবশেষ, কুড়িগ্রামের চারদিকস্থ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইতিহাসের নানা উপাদান, লুপ্তপ্রায় লোকজ গ্রামীণ সামগ্রী।
৩০ একর জমি উদ্ধার করে গড়ে তোলা যেতে পারে জাদুঘর ছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমৃদ্ধশালী পাঠাগার, নাট্যগৃহ, বিনোদনের জন্য পার্ক, শিশুদের জন্য শিশু পার্ক, দৃষ্টি নন্দন পুকুর, জিমাগার কিংবা শিল্প নগরী।
যার ফলে পাল্টে যাবে উলিপুর তথা কুড়িগ্রামের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্প অঙ্গন। পাল্টে যাবে জীবনচিত্র।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বর্তমান কালের স্বাক্ষী দালানটি তৈরি করেন আঠারো শতকে বিনোদী লালের পালক পুত্র শ্রী ব্রজেন্দ্রলাল মুন্সী। তিনি মারা গেলে তার স্ত্রী আশালতা দেবী সকল সম্পত্তি দেখাশুনা করেন। আশালতার মৃত্যুর পর সকল সম্পত্তি পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে। দেখাশুনা করেন না আশালতার পালকপুত্র বিহারী লাল। বিহারী লাল ছিলেন ভবঘুরে, মাতাল এবং নির্লোভ ব্যক্তি। আরডিআরএস অফিসে চাকরী সূত্রে এই বাড়ীটিতে আবাসিক থাকতেন আরডিআরএস এর চাকরীসূত্রে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাইফুল হক । তিনি বিহারীকে লোভ লালসা দেখিয়ে বাড়িটি লিখে নেন।
তথ্যানুসন্ধানে বেড়িয়ে আসে, ব্রজেন্দ্রলাল মুন্সী বিহারী লালকে পালকপুত্র হিসাবে গ্রহণ করেননি গ্রহন করেছিলেন আশালতা । তাছাড়া ব্রজেন্দ্রলাল মুন্সী তাঁর সমস্ত সম্পতি স্ত্রীকে দান করেননি। শুধু ভোগ করার অধিকার দিয়েছিলেন। যার ফলে আশালতা শুধুমাত্র প্রশাসনের বিশেষ অনুমতি নিয়ে সম্পতির অংশ থেকে দান-খয়রাত, পূজা-অর্চনা ও বিভিন্ন উন্নয়নে ব্যয় করতে পারতেন। যেখানে সম্পতি বিক্রি করা আশালতার অধিকার ছিল না সেখানে তাঁর পালক পুত্র পাওয়ার প্রশ্নেই উঠে না। এমন দাবী এলাকাবাসীর।
জানা যায় আশির দশকে এই বাড়ীটি দখল মুক্ত করতে ছুটে আসা গ্রামবাসীকে ঠেকাতে গুলি করে বাদীপক্ষ। সেই গুলিতে চাঁদ মিয়া নামে একজন সদ্য গ্রাজুয়েট ব্যক্তি ও একজন হিন্দু যুবক মারা যান। বর্তমান বাড়ীটির মামলা চলছে।
লেখক: ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু, সহ. সম্পাদক, উলিপুর ডট কম এবং প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, কুড়িগ্রাম।