‘আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান
আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ
মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দীঘি
চাঁদের কিরণ লাগি করে ঝিকিমিকি…’
শিল্পীর রং-তুলিতে আঁকা ছবির মতো আমাদের গ্রাম। মায়ের মমতা মাখান। নিবিড় বন্ধনের মায়ায় জড়ানো। আছে নদী-পুকুর, খাল-বিল, বিস্তীর্ণ জলাশয়। সে জলে খেলা করে নানা প্রজাতির মাছ। সাঁতার কাটে চেনা-অচেনা জলজপ্রাণী। আপন বৈভবে উদ্ভাসিত হয় পদ্ম, শাপলাশালুকসহ কত নাম না জানা জলজ ফুল। ছোট নৌকা কিংবা ডোঙা (তালগাছের গোড়া দিয়ে বানানো এক ধরনের নৌকা) নিয়ে তরতর করে এগিয়ে চলে দুরন্ত শৈশব, কৈশোর আর দুর্নিবার যৌবন। গাঁয়ের মানুষের পাশাপাশি গরু, ছাগল, কুকুর, পাখির জলোল্লাস চলে সকাল থেকে সন্ধ্যে অব্দি। গাঁয়ের বধূরা দলবেঁধে জল নিয়ে ফেরে। জামা-কাপড়, থালা-বাসন পরিষ্কার করে। মাথায় গামছা পেচিয়ে রঙিন পাল উড়িয়ে নৌকার মাঝি গান গায়-
‘আমি রঙিলা নায়ের নাইয়া…’
গাঁয়ের বধূর চুরির শব্দের মতো নদীর কুলকুল ধ্বনি, সূর্যের আলোয় চিকচিক করা বালু দেখে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার কথা-
‘…চিকচিক করে বালু কোথা নাই কাদা
দুই ধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।’
রবি ঠাকুরের দেখা বাংলার গ্রামগুলো আজও তেমনই আছে। এখননও ছেলেমেয়েরা স্নানের সময় গামছা দিয়ে দেশি প্রজাতির ছোট মাছ ধরে। এখনও চৈত্র-বৈশাখ মাসে জল শুকিয়ে গেলে কোমর কিংবা হাঁটু জলে পোলো, বিভিন্ন জাল, কোচ কিংবা দেশি উপকরণ দিয়ে মাছ ধরা উৎসব চলে। মেতে ওঠে গ্রাম উৎসবের পালা-পার্বণে। এখনও পহেলা বৈশাখ, ঈদ, পূজা কিংবা জ্যোৎস্না রাতে বসে মেলা, গান, নাটক আর গল্প বলার আসর। পুঁথিপাঠ, রামায়ণ কিংবা কীর্তনের আসর আজও মানুষের মন কেড়ে নেয়। চোখের জলে আজও মানুষ ভেসে যায় বিষাদ সিন্ধুর করুণ কাহিনীর সুরেলা পাঠ শুনে। পালা গান, জারি, সারি, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, লোকগীতি মানুষের মনকে নাড়া দিয়ে যায়। আজও গ্রামের বুড়ো বটগাছের ছায়ায় মেলা বসে। হাজারো পাখির খাদ্যের জোগান আর ক্লান্ত পথিকের ছাতা হয়ে আগলে রাখে গ্রামের মানুষদের। এখনও গ্রামের কৃষক ধুলা ওড়ানো আঁকাবাঁকা মেঠোপথ দিয়ে মাঠের ধান কেটে গরুর গাড়িতে নিয়ে বাড়ি ফেরে। এখনও ব্যস্ততায় দম ফেলানোর ফুরসত পায় না ঘরের কৃষাণীরা।
আমাদের গ্রাম এখনও গ্রামই রয়ে গেছে। বাড়ির উঠোনে উঠোনে গন্ধরাজ, বেলি, জবা, টগর, নীলকণ্ঠসহ নানা জাতের ফুলের সমারহ। বাঁশ বাগানে আলো-আঁধারির খেলা, একটু বাতাস হলেই কড়াৎ কড়াৎ শব্দের ভীতিকর সেই আওয়াজ আজও শোনা যায়। বাড়ির দক্ষিণ পাশে নিমগাছের বিশুদ্ধ বাতাস বাড়ির মানুষদের অসুখ-বিসুখের হাত থেকে রক্ষা করে। সন্ধ্যাবেলা ভক্তিভরে তুলসীতলা প্রদীপ জ্বলে। আম, আতা, নারিকেল, লাল সাদা রঙের জামরুল, সুপারি, জারুল, তেঁতুল, কাঁঠাল, বরই, ডালিম, পেঁপে ইত্যাদি গাছের বাগিচায় মোড়ানো এক একটা বাড়ি যেন প্রকৃতির কোলে বুক ভরে নিশ্বাস নেয়ার নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
গ্রামে যান্ত্রিক ঘড়ির কাঁটা ধরে সময় চলে না, সময় এগিয়ে যায় প্রকৃতির কাঁটা ধরে। সকালে গ্রামের মানুষের ঘুম ভাঙে পাখির সুরেলা গান আর মিষ্টি মধুর আজানের ধ্বনিতে। হামাগুড়ি দিয়ে সন্ধ্যা নামে- সেও আজান আর পাখির কলকাকলিতে। মানুষের কাজকর্ম, সুখ-দুঃখগাথা রচিত হয় প্রকৃতিকে ঘিরে। গ্রামে প্রকৃতি ও জীবন যেন মিলেমিশে একাকার।
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে গ্রামের প্রকৃতির এ রূপ-মাধুর্যের বিত্ত-বৈভব সব সময়ই একই রকম থাকে না। প্রতিটি ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের প্রকৃতি বদলায়, জীবন বলায়। ঋতু পরিক্রমায় এ দেশের গ্রামের মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছে সেই আদিকাল থেকে। তারা গ্রীষ্মের গরম আর ঝড়-ঝঞ্ঝাকে প্রতিহত করতে শিখেছে প্রকৃতির কাছ থেকে। বর্ষার অবিরল বারিধারা, থিকথিকে কাদা আর পেনসিল রঙা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সূর্যকে মানিয়ে নিয়েছে জীবন চলার পথে। শুভ্র মেঘের ভেসে চলা, মেঘ-সূর্যের লুকোচুরি খেলা, চারদিকে জ্যোৎস্নার বৃষ্টিধারা দেখেই দিন ক্ষণ হিসেব না করেই গ্রামের মানুষ বুঝতে পারে শরৎ এসেছে। শরতের স্বচ্ছতা, পবিত্রতা, নির্মলতা ধারণ করেই মানুষ তাই মানুষের মতো বড় হয়ে ওঠে। কৃষক-কৃষাণীর ব্যস্ততা, সোনালি ফসলের সম্ভার, নবান্ন উৎসবই বলে দেয় হেমন্তের কথা। কুয়াশার চাদর, খেজুরের রস, পিঠে-পায়েশের আয়োজন, হাড় কাঁপানো স্বল্পায়ুর দিনই বলে দেয় শীতের কথা। আর বসন্ত- সে তো আসে রাজার বেশে। প্রকৃতিতে ফুলের হাসি আর জীবনে নতুন ছন্দের দোলাই ঋতুরাজ বসন্তের কথা জানান দেয়।
গ্রাম আর প্রকৃতির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। প্রকৃতি মা। আমরা সেই মায়েরই সন্তান। এভাবেই যুগ যুগ ধরে প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে প্রকৃতির সন্তান হয়ে তার স্নেহের আঁচলে, ভালোবাসার বন্ধনে বেঁচে আছি আমরা। সব বিপদ দূরে ঠেলে বেঁচে থাকব ততদিন; যতদিন প্রকৃতি বেঁচে থাকবে মায়ের মমতা নিয়ে মাথার ওপর সুশীতল ছায়া হয়ে।
লেখকঃ চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন
সুত্রঃ jugantor