জরীফ উদ্দীন,
বিকালে একটু বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম টিএসসিতে। সেই সময় আব্বুর কল। রিসিভ করলাম।
শিখা, কেমন আছিস মা?
আব্বু, ভাল। তুমি?
এই তো ভাল।
আম্মু কেমন আছে?
ভাল রে মা! টিকেট পাইছিস বাড়ি আসার?
না আব্বু পাই নি। তবে পেয়ে যাব!
ঈদে তোর জন্য কত টাকা পাঠানো লাগবে?
বাবা এবার টাকা পাঠাতে হবে না! আমি টিউশনির টাকা পেয়েছি তাই দিয়ে বাড়ি ফিরতে পাব।
তোকে বলিনি টিউশনি করাসনে! মাথার অবস্থা শেষ হবে। এবারই বাদ দিয়ে দে। বল দিবি না?
আব্বু?
হুম!
তবে একটা কাজ করতে পার!
কি কাজ রে মা?
তুমি একটা পাঞ্জাবি আর..
আরে তুই পাঞ্জাবি কি করবি?
তা তো বলা যাবে না! আরও কিনতে হবে একটা লাল টুকটুকে শাড়ি কিনবা!
তুই বিয়ে টিয়ে করলি না কি!
ধাৎ। না আব্বু। এমনটা আমাকে নিয়ে ভাবতে পারলে? তোমাকে না জানিয়ে এতবড় কাজ করি! তোমার আর আম্মুর জন্য কিনবা। আমার জন্য তো অনেক করলে। এবার..
থাক থাক। তোর বিকাশে টাকা পাঠাই দিচ্ছি। ক্লাস না থাকলে বাড়ি আয় শীঘ্রই কতদিন থেকে তোকে দেখিনা। আজকাল বুকের ডান সাইট খুব ব্যথা করে। চোখে ঝাপসা দেখি। হাঁটতে পারিনা আগের মত। মনে হয় আর বেশিদিন বাঁচব না।
আব্বু, এসব কি বলছ? হুম। খুব শীঘ্রই আচ্ছি। বুঝেছি তোমাকে ভাল ডাক্তার দেখাতে হবে। আরও অনেক কথা হয়। শেষে আব্বু ফোনটা রেখে দেয়। আমার আর বন্ধুদের সাথে থাকতে ভাল লাগে না। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হলের দিকে যেতে থাকি।
চোখের সামনে ভেসে উঠে আব্বুর মুখটা। শত দুঃখে মলিন একটা হাসি মুখ। জানি আব্বু এবার ঈদেও নতুন কোনো পাঞ্জাবি কিনবে না। কিনবে না আম্মুর জন্য কোনো শাড়ি। যদি জিজ্ঞাস করি আব্বু বলবে আগের পাঞ্জাবি টা নতুনই আছে। আর আম্মু নতুন কিছুই নিতে রাজি হননা। বলেন, আমি তো বাড়ি থেকে বাহির হইনা যা আছে তাই চলবে। হলের গেটের কাছে আসতেই ফোনের ম্যাসেজ টোন বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখি বিকাশে ক্যাশ ইন সাত হাজার একশ চল্লিশ টাকা। চোখে পানি চলে আসল। আমি তো জানি কত কষ্টে আব্বু টাকা পাঠাইছে। হয়ত এই টাকা পাঠাতে গিয়ে খাবারের বাজেট কমে গেছে। এবার ঈদেও তাদের জন্য কেনা হবে না কোন নতুন পাঞ্জাবি – শাড়ি। আর কত মমতায় পাঠিয়ে দেন আমার জন্য। মোবাইল তাকিয়ে দেখি ইফতারির এখনো ঘন্টা তিন বাকি আছে ভাবলাম আজই বাবার জন্য একটা ভাল পাঞ্জাবি ও মায়ের জন্য লাল শাড়ি কিনে নেই। আর কালকেই টিকেট পেলে সোজা বাড়ি। কুড়িগ্রাম। আমার জন্মভূমি।
আর তিনদিন পরেই ঈদ। যে যেভাবে পাচ্ছে বাড়ি ফিরছে ঈদে। বাসের টিকেট পাওয়া যেন ভাগ্যের ব্যাপার। ট্রেনের টিকেট তো পাওয়াই যায় না। এর মাঝেই কপালে জুটে গেল একটা টিকেট। ফিরছি বাড়ি। বাড়ির চিত্রটা যেন চোখের সামনে ভেসে উঠতে শুরু করল। কবে যে তন্দ্রাভাব এসেছিল বুঝতেই পারিনি। মোবাইলের টোনে তন্দ্রা কেটে গেল। রিসিভ করলাম।
আব্বু বল।
শিখা!
হ্যাঁ, আম্মু বল।
তুই কোথায়?
আম্মু এখনো বগুড়াতে। জানই তো কেমন জ্যাম।
ও।
আব্বু কই?
এই তো বিছানায় শুয়ে। একটু অসুস্থ বারবার তোর কথা বলিতেছে।
ওহ আসতেছি তো।
আচ্ছা আয়।
বাস থেকে নেমে আমাদের বাড়ি পাঁচমিনিটের পথ। তাই বাস থেমে হাঁটা শুরু করলাম আর ভাবতে লাগলাম আব্বু-আম্মু পাঞ্জাবি-শাড়ি পেলে খুব খুশি হবেন। আম্মুকে লাগবে নববধূর মত। তাদের খুশি মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। আবার মনে হল এগুলো দেখে আমাকে খুব বকবেন, কেন এগুলো আনতে গেছি! আমি কি জব করি! ইত্যাদি। দূর! এসব কি ভাবছি! বাড়ি কাছে আসতেই দেখি উঠানে অনেক লোকের ভীর। বাড়ির ভিতর থেকে ভেসে আচ্ছে মায়ের কান্না। আমি কিছু না বলে খুব তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে যাচ্ছি। সামনে আসল রমজান চাচা।
মা রে পথে কোন সমস্যা হয়নি তো?
না, চাচা।
তুই ভেঙে পরিস না। আসলে পৃথিবীতে মানুষ স্থায়ী নয়। এই যে এক সময় আমার আব্বা মানে তোর দাদা ছিল আজ নেই। আমি আছি, আমিও একদিন থাকব না। তোর আব্বুও আমাদের ছেড়ে চলে গেল।…… উনি আর কি বলছেন আমি শুনতে পাচ্ছি না। মাথাটা প্রচণ্ড ঘুরতে শুরু করল। তার মানে আব্বু আর পাঞ্জাবিটা গায়ে দিবেন না, সেই শোকে আম্মু পড়বে না লাল শাড়ি। আমি আর ভাবতে পারছি না। পরে যাচ্ছি। আব্ বু……..!
লেখক, সহ. সম্পাদক, উলিপুর ডট কম