প্রকৌ. রূপম রাজ্জাকঃ
কয়েক বছর থেকে এলাকার বিভিন্ন ব্যাপারে খোঁজখবর রেখে এবং বেশ কিছু মানুষের সাথে মিশে খুব হতাশার একটি চিত্র পেয়েছি। সেটি হচ্ছে – এলাকার লোকজন কেউ কাউকে সম্মানের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেনা। একটা পরিবার আরেকটা পরিবারকে আগের দিনের মতো বিশ্বাস করতে পারেনা। সবাই সবাইকে অদ্ভুত সন্দেহের চোখে রাখে। গ্রাম অঞ্চলে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সুযোগ পেলে একজন আরেকজনের ক্ষতি করতে পিছপা হয়না, এমনকি পূর্বশত্রুতা না থাকলেও সেটি করে এক ধরনের আদিম আনন্দে মেতে উঠে। বেশীরভাগ পরিবারের ভেতরেই ঐক্য নাই। সামান্য বিষয় নিয়ে রেষারেষি, ভুল বোঝাবুঝি, অপমান, ইত্যাদি। কিছু মানুষ হয়তো অনেকদিন একসাথে চলছে বা নিয়মিত আড্ডা দিচ্ছে। মনে হবে তারা ভালো বন্ধু। কিন্তু একটু খোঁজ নিলে দেখা যায় এরা কেউই কারো ভালো বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠতে পারেনি। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, বাস্তবে বেশীরভাগ মানুষই একা হয়ে আছে। প্রতিবেশী একজনের বিপদে আরেকজন হয় শুধুই নীরব দর্শকের নয়তো প্রতিপক্ষের দাবার ঘুটির ভূমিকা রাখে। গ্রাম/মহল্লা পর্যায়ে সামাজিক প্রশাসন এখন একদম নাই বললেই চলে। এর ফলে সামান্য ঘটনাতেই মামলা মোকদ্দমা বেড়েই চলেছে। কিছু লোক বা পরিবার বারবার একই ধরনের অপরাধ করেই যাচ্ছে। যে যত বেয়াদবি করে সাধারন মানুষের কাছে সে ততই ক্ষমতাশালী। সমাজ ব্যবস্থা হয়ে গেছে পুরোপুরি অভিভাবকহীন।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। প্রাইমারী, হাই স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের পড়াশুনা এলাকাতেই করেছি। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য বের হয়েছিলাম এবং সেই থেকে বাইরেই আছি। কিন্তু জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ সময় এলাকায় অবস্থানের পরও এলাকার খুব অল্প সংখ্যক মানুষকে ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত মনে করতে পারি আমি। একটা সময় অনেককেই কাছের লোক ভাবতাম। পরে বিভিন্ন সময় সামান্য ঘটনায় অনেকের কুৎসিত রূপ দেখেছি। একটি ঘটনার কথা বলি। একজনের সঙ্গে আমার ছোটবেলা থেকে সুসম্পর্ক ছিল, আমি সেটা মেইন্টেইনও করতাম। তার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে উত্তরণের জন্য নিজের সাধ্যমত চেষ্টা করে সবসময় ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো থেকেছি। একবার সামান্য একটি ঘটনায় কয়েকদিন মনোমালিন্য ছিল। সেই ফাঁকে সে আমার বড় ধরনের ক্ষতি করা একজন ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব তৈরি করেছিল। উদ্দেশ্য, আমাকে মনঃকষ্ট দেয়া। এরকম ঘটনা ডজন ডজন প্রত্যক্ষ করেছি। আমার ধারনা, আমাদের এলাকার বেশীরভাগ মানুষই বারবার এরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে।
পড়াশুনা ও কর্মসূত্রে অনেক বছর থেকে বাইরে আছি। বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। নিজের এলাকায় আমার যে পরিমাণ বিশ্বস্ত মানুষ নাই, তার চাইতে কমপক্ষে ২০ গুন বিশ্বস্ত মানুষ বাইরে তৈরি হয়েছে। হতে পারে আমি ভাগ্যবান যে এতো মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। কিন্তু বাইরে এসেও এলাকার অনেক মানুষের সাথে বিভিন্ন সময় মিশেছি, কিন্তু তাদের অল্প কিছু মানুষের সাথেই কেবল সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ব্যাপারটা সত্যিই বেদনাদায়ক। আমাদের এলাকার বেশীরভাগ মানুষ এখনো ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত গণ্ডির বাইরে এসে মানুষের সঙ্গে মেশা বা মানুষের জন্য কিছু করার ব্যাপার কল্পনাই করতে পারেনা। এটাই এই বন্ধুহীনতার প্রধান কারণ বলে আমার মনে হয়। মানুষের মধ্যে কমন মহৎ এজেন্ডা না থাকলে এই সমস্যা আরও প্রকট হবে।
এতো কিছু বলার বিশেষ কোন কারণ নাই। শুধু কষ্টের অভিজ্ঞতা এবং কিছু উপলব্ধি শেয়ার করলাম। তবে এলাকার তরুণ প্রজন্মের যারা আছে, প্রধানতঃ যারা এখনো স্কুল কলেজের গণ্ডিতে আছে, তাদেরকে সামান্য উপদেশ দিতে চাই। তোমরা নিজেদের মাইন্ডসেট বড় লক্ষের জন্য স্থির করো। বিখ্যাত মানুষদের জীবনী পড়ো। এলাকার বড়দের মতো সামান্য মেম্বার বা চেয়ারম্যান নির্বাচনকেন্দ্রিক জটিলতায় না জড়িয়ে নিজেদেরকে আলাদা করে আধুনিক প্রযুক্তির উপর দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করো। প্রযুক্তি এমন একটি জিনিস যা তোমাকে সব মন্দ জিনিস থেকে দুরে রাখবে এবং জীবনের ত্বরিত উত্তরণে সহায়তা করবে। পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে দেশের ও বিদেশের অনুপ্রেরণামূলক ঘটনা বা আবিষ্কার সমন্ধে জানার চেষ্টা করো। অবসরে গঠনমূলক লেখালেখিও করতে পারো। এসবের মাধ্যমেই কেবল সম্ভব নিজেকে বের করে নিয়ে আসা। নইলে অবস্থার কোন পরিবর্তন হবেনা আর তোমাদেরকেও পড়ে থাকতে হবে সমস্যার বর্তমান তিমিরেই।
সবার জন্য শুভ কামনা রইল। সুন্দর বর্তমান ও সম্ভাবনাময় অনাগত ভবিষ্যতের জন্য আমরা যেন একে অপরের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখি। এটাই আজকের প্রত্যাশা।
লেখকঃ প্রকৌশলী রূপম রাজ্জাক
সম্পাদক, উলিপুর ডট কম
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), ওএস ক্লিকস