।। নিউজ ডেস্ক ।।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার রিয়াজ উদ্দিন আহমেদকে কুড়িগ্রামের নতুন পুলিশ সুপার (এসপি) হিসেবে পদায়ন করায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চলছে সমালোচনার ঝড়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় খুলনায় আন্দোলনকারীর ওপর ব্যাপক নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এজন্য কুড়িগ্রামের ছাত্র-জনতা তাকে কুড়িগ্রামের এসপি হিসেবে দেখতে চায় না। তিনি যোগদান করলে তার বিরুদ্ধে কুড়িগ্রামে আন্দোলন হবে বলেও হুশিয়ারি দিয়েছেন কুড়িগ্রামের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা।
গত মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে তাকে কুড়িগ্রামের এসপি হিসেবে বদলি ও পদায়ন করা হয়।
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদকে কুড়িগ্রামে বদলির আদেশ প্রকাশ হলে মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে নিয়ে নানা বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এই পুলিশ কর্মকর্তা খুলনায় আন্দোলনকারীর ওপর ব্যাপক ‘নির্যাতন’ করেছেন এমন অভিযোগ তুলে তাকে কুড়িগ্রামে পদায়ন না করতে জোর দাবি জানানো হচ্ছে। অবিলম্বে তার বদলি আদেশ বাতিল করে তাকে চাকরি থেকে অপসারণের দাবিও তুলেছেন কেউ কেউ।
তাছাড়া, তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে যে তিনি আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার এমন কিছু ছবি ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে তাকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তিদের সাথে দেখা গেছে।
লন্ডন প্রবাসী সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট ও জ্যেষ্ঠ ডেটা প্রকৌশলী রূপম রাজ্জাক বলেন, রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ তার বর্তমান কর্মস্থল খুলনায় ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছেন। এর আগে র্যাব-১ এ কর্মরত থাকা অবস্থায় গুম-খুনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত ছিলেন। এছাড়া নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থপাচারের মতো অপরাধের সাথেও তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। এসবের বাইরেও তিনি অনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে সখ্যতার বিভিন্ন ছবি নেট দুনিয়ায় দেখা যাচ্ছে। তাকে আওয়ামী পরিবারের সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল হাসিনা সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী কর্তৃক সুপারিশকৃত একটি চিঠিতেও। এসব জেনে তার নতুন পদায়নকৃত কর্মস্থল কুড়িগ্রামের মানুষ সোচ্চার হয়েছেন। ইতিমধ্যেই প্রতিবাদ করেছেন সোশ্যাল মিডিয়াসহ সাধারণ আলোচনায়। সেখানকার মানুষ ফুঁসছে এই বিতর্কিত ব্যক্তির আগমনের আগেই। তার মতো অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার না হওয়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান তথা ত্যাগের সাথে বেইমানির সমতুল্য। তাই তার পদায়ন নয়, তার অপরাধের বিচার করতে হবে আগে।
২৪তম বিসিএসের এই কর্মকর্তার বরখাস্ত দাবি করে কুড়িগ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম শাকিল তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘কুড়িগ্রামে পুলিশ সুপার হিসেবে আসতেছে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ। সে একজন খুনি এবং সাইকোপ্যাথ পুলিশ অফিসার। ওর বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলুন। এই এসপি কুড়িগ্রামে আমরা চাই না। ওরে পুলিশ বাহিনীতেও চাই না। দ্রুত বরখাস্ত করা হোক।’ একই দাবিতে পোস্ট করেছেন আরও অনেকে।
এদিকে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদকে এসপি হিসেবে সুপারিশ করা একটি ডিও (ডামি অফিসিয়াল) লেটার ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ২০২৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান, এমপি কর্তৃক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর দেওয়া ওই ডিও লেটারে পুলিশ কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন আহমেদকে ‘আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্য’ উল্লেখ করে তাকে প্রতিমন্ত্রীর নির্বাচনি এলাকা খুলনা অথবা মৌলভীবাজার জেলায় বদলি অথবা পদায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে ডিও লেটারটির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
এছাড়া, সংগীতশিল্পী তাবিজ ফারুকের একটি পোস্টও এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। গত ১৪ আগস্ট তার পোস্টে তিনি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে খুলনায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ছাত্রদের ওপর ‘নির্মম নির্যাতনের’ অভিযোগ করেন। ফারুক তার পোস্টে আরও উল্লেখ করেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনে খুলনার মেট্রোপলিটন এলাকায় সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর নির্মমভাবে অত্যাচার চালিয়েছে এই সেই কুখ্যাত পুলিশের এসপি পদমর্যাদার রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ (২৪ তম বিসিএসের কর্মকর্তা)।’
তাবিজ ফারুক আরও দাবি করেছেন যে, ‘অতীতেও এই দুর্নীতিবাজ ও সাইকো পুলিশ অফিসার রিয়াজউদ্দিনের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নে এ চাকরির সুবাদে বিভিন্ন নিরীহ ও সাধারণ ছাত্র, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী এমনকি সাংবাদিকরাও হয়রানির শিকার হন। সেই সঙ্গে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাধারণ মানুষদের হত্যা গুম ও খুনসহ বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দিয়ে মানুষকে ফাঁসিয়ে দেওয়াই ছিল দৈনিক রুটিন। দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আমেরিকায় তার বোনদের ও আত্মীয়স্বজনের কাছে অবৈধপথে পাচার করেছে। চাকরি থেকে সাসপেন্ডসহ বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে আবেদন জানাচ্ছি ছাত্রছাত্রী ও বাংলার জনতার পক্ষ থেকে।’
এমন বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তাকে কুড়িগ্রামে এসপি হিসেবে পদায়নের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন জেলার শিক্ষার্থী ও তাদের প্রতিনিধিরা। তারা অবিলম্বে এই এসপির বদলির আদেশ বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, শিক্ষার্থী-জনতার ওপর নির্যাতনকারী ওই পুলিশ অফিসারকে আমরা চাই না। আমাদের আপত্তি উপেক্ষা করে কুড়িগ্রামে তাকে পদায়ন করা হলে এসপি অফিস ঘেরাওসহ কঠোর আন্দোলন হবে। আমরা চাই না শান্ত কুড়িগ্রাম আবারও অশান্ত হোক।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনে কুড়িগ্রামে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বকারী অন্যতম সংগঠক মিনারুল ইসলাম বলেন, ‘ওই এসপি খুলনায় আমাদের আন্দোলনকে বিতর্কিত করেছেন। তিনি আমাদের ছাত্রদের ওপর নির্যাতন করেছেন। আমরা সেসব প্রমাণ পেয়েছি। আমরা এ রকম নরপিচাশ এবং ছাত্র নির্যাতনকারী ব্যক্তিকে কুড়িগ্রাম জেলায় চাই না। ওনাকে যদি এখানে পদায়ন করা হয় তাহলে এসপি অফিসসহ অন্য সরকারি অফিস ঘেরাও করা হবে।’
পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যদি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে কোনো সত্যতা থাকে, তবে তা গভীরভাবে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।