।। নিউজ ডেস্ক ।।
অর্থ ছাড়া কোনো সেবাই যেন মেলে না কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিসে। শিক্ষা উপবৃত্তি, বয়স্ক, প্রতিবন্ধি এবং বিধবা ভাতার আওতায় না পড়েও টাকার বিনিময়ে অথবা স্বজনপ্রীতির মাধমে অনেকেই সুবিধা গ্রহণ করছেন। একই কর্মস্থলে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করে স্থানীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গড়া সিন্ডিকেট চক্রের হাতে জিম্মি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিস।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা এসএম হাবিবুর রহমান ২০০৯ সাল থেকে এবং ফিল্ড অফিসার সুপারভাইজার রিয়াসাদ আজিম জীম, ইউনিয়ন সমাজকর্মী শহীদুর রহমান, শিউলি বেগমসহ কয়েকজন কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরে একই কর্মস্থলে অবস্থান করছে। তাদের ছত্রছায়ায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গ্রাম পুলিশদের নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র। এই সিন্ডিকেট চক্রের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সদর উপজেলার বয়স্ক, প্রতিবন্ধি, বিধবা ভাতা সুবিধাভোগীর তালিকা। সিন্ডিকেট চক্রের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় নানা ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সুবিধাভোগীদের। সিন্ডিকেট চক্রের সদস্য হলোখানা ইউনিয়নের সমাজকর্মী শিউলি বেগমের আত্নীয় হবার সুবাদে প্রতিবন্ধি না হয়েও প্রতিবন্ধি ভাতা তোলেন সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের উদ্যোক্তা সাইদুর রহমান। যার উপকারভোগী নং-০৩৪৯০০৪১০৯৪। সাইদুর রহমানের মা সাহিদা বেগম-০৩৪৯০০৩৯৪২৪, পিতা আবুল হোসেন-০৩৪৯০০৩৯৪১৯, ফুফু আম্বিয়া খাতুন-০৩৪৯০০৩৮৭১৬। এছাড়াও প্রতিবন্ধি না হয়েও বিপুল মিয়া-০৩৪৯০০৪১৫৭৯, হাছেন আলী-০৩৪৯০০৩৮৭০১, হায়দার আলী-৩৪৯০০১৬৪৯৩ সুবিধাভোগ করছেন।
সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের মরাটারি ছত্রপুর গ্রামের বাসিন্দা শ্রমিক মেহের জামাল ও আছমা বেগম দম্পতির ছেলে নয় বছরের শিশু আবু আজাদ শারিরিক প্রতিবন্ধি। প্রায় দু’বছর আগে প্রতিবন্ধি ভাতার জন্য আবেদন করে পরিবারটি। পেয়েও যায় ২০১৫৪৯১৫২৮৫১০৭৮৭৭-০২নং একটি প্রতিবন্ধি কার্ড। এই কার্ড ইস্যু করা হয় ২০২২সালের ২৭ আগষ্ট। কিন্তু এই কার্ড জুটলেও ভাতার টাকা আজও জোটেনি শিশুটির ভাগ্যে। এই বিষয়ে একাধিকবার সমাজসেবা অফিসে যোগাযোগ করেও মেলেনি কোন সুরহা। উল্টো সমাজসেবা অফিস তার নিকট থেকে নাম্বার পরিবর্তনের একটি আবেদন জমা নেন চলতি বছরের জুন মাসে। অথচ দীর্ঘদিন ধরে অন্য নাম্বারে টাকা গেলেও পরিবারটিকে সেই নাম্বার দেয়া হয়নি।
পাশের ঘোগাদহ ইউনিয়নের হাজিরকুটি গ্রামের অসুস্থ বয়বৃদ্ধ রুপভান বেওয়া। তার ৪৯১৫২২৮২৪৬৩১৭ নং এ দু’বার ভাতা পেলেও তিন বছর ধরে তার প্রতিবন্ধি ভাতা বন্ধ রয়েছে। এখন অসহায় অবস্থায় খেয়ে না খেয়ে দিনাপাতিত করতে হচ্ছে বৃদ্ধা রুপভান বেওয়াকে। পরিবারের সদস্যরা মেম্বার,চেয়ারম্যান এবং সমাজসেবা অফিস গিয়েও আজও চালু করতে পারেনি এই বৃদ্ধার প্রতিবন্ধি ভাতা।
বিধবা, প্রতিবন্ধি ভাতার তালিকাতেও রয়েছে গড়মিল। নাম,ঠিকানা সব ঠিক থাকলেও ঠিক নেই শুধু মোবাইল নাম্বার। এমন অসংখ্য মোবাইল নাম্বার পরিবর্তন করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেট চক্রের সদস্যগণ। অথচ সুবিধাভোগীরা কিছুই জানেন না। সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের ০৩৪৯০০৩৩১৮৪ নং এর মৃত শহিদুল ইসলাম। প্রায় এক বছর আগে মারা গেলেও প্রতিবন্ধি ভাতা তালিকা থেকে তার নাম কর্তন হয়নি। শুধুমাত্র ভাতা পাওয়া মোবাইল নাম্বার পরিবর্তন করে অন্য কেউ টাকা তুলে নিচ্ছেন। এরমধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য, মোস্তনা খাতুন ভাতাভোগী নং-০৩৪৯০০৪০৭১৬,নুরমিনা খাতুন-২১৫৬৬, হাবিব-৩৭৬৭০,সফিকুল-২২৯৭৯,গণি মিয়া-৩৮৯৮১,রবিয়াল হক-৩৯০৬৫,গুলজান বিবি-২৩৫৮৬,আমেনা খাতুন- ৩৯৯৮২,খাদিজা বিবি-৪৫১৯৬,মতিয়ার রহমান-৩৯০৮২,ছপুরা পাগলী-৪০৩৭৮,সমশের আলী ২১৪৪৯, রুপভান বিবি-২৭৩৮৪,আবেয়া পাগলী-২১৯৬৬,শহিদুল ইসলাম-৩৩১৮৪, মাছিমন-২২৬২১, রশেদা-৩৫৮৪৯, ছলিমা-৩২৫৯৭, আফরোজা-৩৪৪১৪১, তাজনিন আক্তার-২৪৩১২, কাছিরন বেগম-২২৮৫৭, ময়ফুল-৩৯০৪৮,মারুফা আক্তার-৩৯০৮৭,লুৎফা বেগম-৪১২৩১,জোসনা বেগম-৪০০২৬, মোহাম্মদ আলী-৩৯০৫০,সুমি খাতুন-১৫৯৮০,আজাদ-৭৫৬৫৫, বালিজন-২২৮৬১,এনামুল হক-৩৮৯৬১, ছালেমা-৬৮২৫১, রাহেনা-৪০৯৮৪, হাছেন আলী-৫১১৩৭, উপিজন-৭৫৭৫৩, সানাউল্লা-৭৫৩৮৮,বাসন্তি-৭৫৩৬৮, অলোকা রানী-৬৩২৯৮। গত ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা এস.এম হাবিবুর রহমান স্বাক্ষরিত ইউনিয়ন পরিষদে পাঠানো চিঠিতে দেখা যায়,সেখানে শুধু বয়স্ক ও বিধবা ভাতার তালিকা চাওয়া হয়েছে। প্রতিবন্ধী ভাতার কোনো তালিকা চাওয়া হয়নি। কারণ খুজতে পাওয়া যায় চমকপ্রদ তথ্য। উপজেলায় প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য বরাদ্দও ছিলো-১২৩৯টি। এরমধ্যে চেয়ারম্যানগণ প্রতিস্থাপনের জন্য পাঠানো তালিকায় আবেদনকৃতদের নাম দিয়েছেন,হলোখানা ইউপি-৩৭টি,বেলগাছা-৪৯টি,মোগলবাসা-২৮টি,যাত্রাপুর-২৪টি,পাঁচগাছি-১৭টি, ঘোগাদহ -২৩টি এবং ভোগডাঙ্গা- ২২টি। সিন্ডিকেট চক্র আবেদনের সময় শেষ হয়ে গেলেও অন্তত এই ২৩০টি ভাতা নিজেরা বিক্রি করেন। এই ২৩০জনের মধ্যে আবার বেশির ভাগই টাকা পায়নি বা ভাতাভোগীর সঠিক বিকাশ নম্বর দেওয়া হয়নি। আরও দেখাযায়,কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নে প্রতিবন্ধী ভাতাভোগী নম্বর-০৩৪৯০০৮০১৬৬ থেকে ০৩৪৯০০৮৬৯৪৬ এরমধ্যে ৩৮টি এবং হলোখানা ইউনিয়নে উপকারভোগী নম্বর-০৩৪৯০০৮৫১৩৯ থেকে ০৩৪৯০০৮৬৭৫৫ এর মধ্যে ৪৩টি,দুই ইউনিয়নে মোট ৮১টি ভাতাভোগী আবেদন না করেও চুড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এদের অনেকের প্রতিবন্ধী কার্ড নেই, অফিসে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। অনেকেই জানে না তাদের নামে ভাতা হয়েছে। এই না জানা ব্যক্তিদের নিকট দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে ভাতা করে দেবার কথা বলে বিকাশ নম্বরটি সঠিক করে দেয়া হচ্ছে।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একাধিক সুবিধাভোগী জানান,শহীদুর রহমান ইউনিয়ন সমাজকর্মী পদে চাকুরি হলেও তিনি অফিসারের আস্থাভাজন হওয়ায় তিনি সমাজসেবা অফিসেই কাজ করেন। টাকা ছাড়া তার নিকট থেকে কোন কার্ড পাওয়া যায় না। প্রতিটি কার্ডের জন্য ৩০০ টাকা হতে পাঁচ হাজার করে টাকা নেন। আর জীম কম্পিউটারে কাজ করেন। অথচ সে নিজেও একজন প্রতিবন্ধ হয়েও ভাতা করে দেয়া এবং মোবাইল নাম্বার পরিবর্তন করার জন্য টাকা নেন।মাঠ পর্যায় এদের লোক রয়েছে। তাদের ছাড়া কোন ভাতা পাওয়া যায় না।
পরিবারের ৪ সদস্য প্রতিবন্ধি হবার কথা স্বীকার করে উদ্যোক্তা সাইদুর রহমান বলেন,আমার বাম হাতের ব্যাথার কারণে প্রতিবন্ধি হয়েছি। ভাতাও পেয়েছি বেশ কয়েক বার। আমার মা চোখে কম দেখে এবং বাবা অচল আর ফুফু পা বাকা করে হাটে। এজন্য আমার দুসম্পর্কের বোন শিউলি বেগমের মাধ্যমে প্রতিবন্ধি ভাতা পেয়েছি। এখনও কাগজপত্র তার কাছে রয়েছে। বর্তমানে ভাতা বন্ধ রয়েছে বলে দাবী করেন তিনি।
সাইদুর রহমানের মা সাহিদা বেগম বলেন,আমার ছেলে প্রতিবন্ধি নয় এবং স্বামী ও আমি দু’জনে অসুস্থ। তাই বেশ কয়েক বার প্রতিবন্ধি ভাতা পেয়েছি।
হায়দার আলী বলেন,আমার বয়স হয়েছে। ভারী কাজ করতে পারি না। হাটুতে ব্যথা হবার কারণে জামাইকে দিয়ে দু’হাজার টাকা অফিসে খরচ করে প্রতিবন্ধি তালিকায় নাম তুলেছি। কিন্তু এখনো কোন টাকা বা কার্ড পাইনি।
মেহের জামাল বলেন,আমার ছেলের শারিরিক প্রতিবন্ধি। কিন্তু দু’বছর থেকে উপজেলা সমাজসেবা অফিস ঘুরেও টাকা পাচ্ছি না। এক বছর আগে প্রতিবন্ধি কার্ড পেয়েছি। অনলাইন আবেদনে ২৩৩৯নং মোবাইল নাম্বার দিয়েছি। কিন্তু শুনেছি সেই নাম্বার বদলে ৯৯৭৪নাম্বারে টাকা যাচ্ছে। সেজন্য কম্পিউটারে কাজ করে রিয়াসাদ আজিম জীম স্যারকে বললে তিনি বলেন কোন নাম্বার দেখানো যাবে না। উল্টো আমার কাছ থেকে মোবাইল নাম্বার পরিবর্তনের জন্য ২৩জুন একটি আবেদনে টিপ সই নেন। সেখানেও আমার পূর্বে দেয়া মোবাইল নাম্বারটি দিয়েছি।
আছমা বেগম বলেন,দু’বছর থেকে টাকা পয়সা খরচ করে বহুবার গেছি সমাজসেবা অফিস। কিন্তু হামরা গরিব মানুষের কথা কেউ শুনে না। হয়রানির স্বীকার হতে হয়। কামলা দিয়ে কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে সংসার চলে। অথচ আমরা দু’বছর থেকে টাকা পাই না। আর সেই টাকা অন্য কেউ পাচ্ছে। সেই নাম্বার দেয় না।
অসুস্থ রুপভানের ভাবী রেজিয়া বেগম বলেন,দু’বার প্রতিবন্ধি ভাতা পেয়েছে। কিন্তু তিন বছর ধরে সেই টাকা পায় না। বেশ কয়েক বার অফিস গিয়েও কাজ হয়নি। সংসার চলে না আর বার বার অফিস যাওয়া-আসার টাকা পয়সা নেই। তাই অফিস যাওয়া বাদ দিয়েছি।
মৃত শহিদুল ইসলামের স্ত্রী মালেকা বেওয়া বলেন,আমার স্বামী প্রতিবন্ধি ভাতা পেয়েছিল। তিনি মারা গেছেন এক বছর পার হয়েছে। সেই থেকে আমাদের ০২৭ ফোন নাম্বারে কোন টাকা আসে না। কিন্তু তার নাম, ঠিকানাসব ঠিক থাকলেও ৩৬৯ ফোন নাম্বারে যে টাকা যায় তা আমরা জানি না। এটা আমাদের কোন আত্নীয় স্বজনেরও ফোন নাম্বার নয়।
প্রতিবন্ধি না হয়েও তালিকায় নাম অর্ন্তভুক্ত প্রসঙ্গে ইউনিয়ন সমাজকর্মী শিউলি বেগমের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন এই বিষয়ে আপনার সাথে কোন কথা বলবো না আমি।
যাত্রাপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর বলেন,প্রতিবন্ধি ও বিধবা তালিকা উপকারভোগী তালিকা নিয়ে অসন্তুষ্ট স্থানীয় অনেক জনপ্রতিনিধি। অনেক সুবিধাভোগীর নাম,নাম্বার ঠিক থাকলেও তারা দীর্ঘদিন ধরে টাকা পাচ্ছে না বলে জানান তিনি। এছাড়াও তিনি আরও বলেন,প্রতিবন্ধি ভাতায় সুবিধাভোগী অনেকেই মারা গেলে তার পরিবর্তে নতুন বা অপেক্ষামান তালিকা থেকে নেয়। কিন্তু প্রতিবন্ধিদের নতুন বরাদ্দ থেকে কোন নাম নেয়া না। কিভাবে সেগুলো সমন্বয় করে সমাজসেবা অফিস সেটা তারা ভালো বলতে পারবে।
এই বিষয়ে সদর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা এসএম হাবিবুর রহমান সিন্ডিকেট নেই দাবী করে বলেন, সুবর্ণ নাগরিক কার্ড যাদের রয়েছে তারা ভাতা পাচ্ছেন। অনেকেই আগে পেলেও সুবর্ণ কার্ড না থাকায় তাদের ভাতা বন্ধ রয়েছে। ভাতা না পাওয়ার অভিযোগ তাদেরই। এছাড়াও অনেক সুবিধাভোগী সরকারের অন্য সুবিধার আওতায় থাকা একই মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করার জন্য ভাতা বন্ধ থাকে। আবার অনেক ভাতাভোগী তাদের মোবাইলের গোপন পিন নাম্বারটি শেয়ার করে থাকেন। হ্যাকাররা সহজেই টাকা তুলে নিচ্ছেন। ফলে ভাতা গেলেও তা বুঝতে পারে না। এমন নানা বিধ সমস্যা রয়েছে। তবে তিনি বলেন,আমার অফিসের কোন স্টাফের বিরুদ্ধে কেউ মৌখিক বা লিখিত কোন অভিযোগ দেয়নি টাকার বিনিময়ে কার্ড করে দেয়া বা ভাতা বন্ধ করার বিষয়। তবে এই বিষয়ে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনী ব্যবস্থা নেবার আশ^াস দেন তিনি।