।। নিউজ ডেস্ক ।।
জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিইয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রবিবার (২৬ আগস্ট) সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে তিনি এই ভাষণ শুরু করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের নানা কর্মপরিকল্পনা নিয়ে তিনি একটি ধারণা দেন এই ভাষণে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বৈষম্যহীন, শোষণহীন, কল্যাণময় এবং মুক্ত বাতাসের রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জনতা আন্দোলেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তিনি তাদের সেই স্বপ্নপূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ। এ সময় তিনি বলেন, বাংলাদেশকে আর কোনদিন যেন কেউ পুলিশি রাষ্ট্র বানাতে না পারে সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে; সংবাদ পত্রের অবাদ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে, বিদেশি সাংবাদিকদের অলিখিত যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা উঠিয়ে দেওয়া হবে; বিচারের আগে আদালত অঙ্গনে হামলা করে বিচার করা আমাদের ছাত্রদের আন্দোলনের ফসলকে সমস্যায় ফেলবে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কখন নির্বাচন হবে সেটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের নয় দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন। আমরা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছি। তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। দেশের আপামর জনসাধারণ আমাদের নিয়োগ সমর্থন করেছে। আমরা ক্রমাগতভাবে সবাইকে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে যাব, যাতে হঠাৎ করে এই প্রশ্ন উত্থাপিত না হয়, আমরা কখন যাব। তারা যখন বলবে আমরা চলে যাব।’
সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কাজ শুরু করেছে উল্লেখ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘দেশবাসীকে অনুরোধ করব, একটা আলোচনা শুরু করতে, আমরা সর্বনিম্ন কী কী কাজ সম্পূর্ণ করে যাব, কী কী কাজ মোটামুটি করে গেলে হবে। এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা একটা দিকনির্দেশনা পেতে পারি। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক আলোচনা থেকেই আসবে।’
এই দিকনির্দেশনা না পেলে তাঁরা দাতা সরকার এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলোচনায় দৃঢ়তার সঙ্গে অগ্রসর হতে পারছেন না বলেও উল্লেখ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমরা আমাদের পক্ষ থেকে মেয়াদ বৃদ্ধির কোনো প্রশ্ন তুলব না। আমরা আপনাদের সকলের দোয়া চাই। যে ক’দিন আছি সে সময়টুকু উপদেষ্টামণ্ডলীর প্রত্যেকে নিজ নিজ সাধ্যমতো দেশের এই সংকটকালে, সংকট উত্তরণে যেন নিজ নিজ মেধা সাধ্যমতো কাজে লাগাতে পারি, নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে সুযোগ ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করলাম, আমরা আমাদের মতানৈক্যের কারণে সেটা যেন হাতছাড়া না করে ফেলি এটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। এ সুযোগ এবার হারিয়ে ফেললে আমরা জাতি হিসেবে পরাজিত হয়ে যাব।’
নির্বাচন কমিশনকে সংস্কার করে যেকোনো সময় আদর্শ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রাখা হবে বলেও জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে সফল পরিণতি দিতে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা খাত এবং তথ্য প্রবাহে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পূর্ণ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা হবে। এর লক্ষ্য হবে দুর্নীতি, লুটপাট ও গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা।’
দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এবং লক্ষ লক্ষ মা–বোনের আত্মদানের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের হাতে ধ্বংস হয়ে গেছে। দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে দুর্নীতি। বাংলাদেশ এমন এক দেশে রূপান্তর হয়েছে যেখানে স্বৈরাচারের পিওনও দুর্নীতির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ করার মতো অকল্পনীয় কাজ করে গেছে নির্বিবাদে। শিক্ষা খাতকে পঙ্গু করে দিয়েছে, ব্যাংকিং ও শেয়ার বাজার খাতে লুটপাট, প্রকল্প ব্যয়ে বিশ্ব রেকর্ড, অবাধ সম্পদ পাচার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে নিজ দলের পুতুলে রূপান্তর, বাক স্বাধীনতা হরণ, মানবাধিকার হরণ এসবই হিমশৈলের অগ্রভাগ মাত্র। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ফ্যাসিবাদী সরকার জনগণের সাংবিধানিক ক্ষমতা ও অধিকার খর্ব করেছে। দুঃশাসন, দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার নিপীড়ন, বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যম জনসুরক্ষা বিপন্ন করেছে। জনগণকে নির্যাতন, বঞ্চনা ও বৈষম্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের মানুষসহ কোটি কোটি মানুষের ভোটাধিকারকে বছরের পর বছর হরণ করেছে।
সবাইকে ধৈয্য ধারণ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এখনই সব দাবি পূরণ করার জন্য জোর করা, প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যক্তিবিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলা, মামলা গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা, বিচারের জন্য গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে আদালতে হামলা করে আগেই এক ধরনের বিচার করে ফেলার যে প্রবণতা, তা থেকে বের হতে হবে।
ব্যাংক খাতের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা জানান, ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘ মেয়াদি সংস্কারের জন্য ব্যাংক কমিশন গঠন করা হবে। আর্থিক খাতে সার্বিক পরিস্থিতি এবং সংস্কার বিষয়ে একটি রূপকল্প তৈরি করে দ্রুত প্রকাশ করা হবে। শেয়ারবাজার, পরিবহন খাতসহ যেসব ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে তা নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিচার বিভাগকে দুর্নীতি ও দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, অপহরণ এবং আয়না ঘরের মতো চরম ঘৃণ্য অপকর্মের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।
এ সময় তিনি লুটপাট ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা উল্লেখ করেন।
দেশরক্ষা বাহিনী, পুলিশ ও অন্যান্য সব বাহিনীর মধ্যে যারা হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন বা শারীরিক, মানসিক অত্যাচারে সরাসরি জড়িত তাদের চিহ্নিত করে বিচারের ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাবকে গুম–নির্যাতনের কাজে লাগিয়ে তাদের কলঙ্কিত করা হয়েছে। তারা দেশের গৌরব। তাদের কিছু অতি উৎসাহী সদস্যের কারণে পুরো বাহিনীকে আমরা কলঙ্কিত দেখতে চাই না। আমরা অপরাধীদের চিহ্নিত করতে চাই এবং তাদের শাস্তি দিতে চাই। যেন ভবিষ্যতে কারও হুকুমে দেশপ্রেমিক কোনো বাহিনীর, পুলিশের, র্যাবের কোনো সদস্য হত্যাকাণ্ড, গুম ও অত্যাচারে জড়িত হওয়ার সাহস না করে।’
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ফ্যাসিবাদী সরকার গণমাধ্যমের ওপরও দলীয়করণ ও নির্যাতনের বোঝা চাপিয়েছিল। জনগণের তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তথ্যের প্রবাহে বিদ্যমান আইনি ও অন্যান্য বাধা অপসারণ করা হবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করে এমন সব আইনের নিপীড়নমূলক ধারা সংশোধন করা হবে। ইতিমধ্যে এ ধরনের আইনগুলো চিহ্নিত করে এই প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।
ভাষণে তিনি আরও উল্লেখ করেন, শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য দমন, শিক্ষার্থীদের জন্য সৃজনশীল, নিরাপদ ও ভীতিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা সরকারের অঙ্গীকার। জনগণের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এ খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার। নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী সকলেই এ দেশের নাগরিক এবং সমান আইনের সুরক্ষার অধিকারী ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে রাজনৈতিক ঐক্যের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করা হবে।
চলমান বন্যা পরিস্থিতির বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বন্যা কবলিত এলাকার সব মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সরকারের সঠিক সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকারের যত কার্যক্রম আছে সব সচল করা হয়েছে। বন্য–পরবর্তী কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য করণীয় কী তা স্থির করার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
সবার সহযোগিতা চেয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রতিদিন সচিবালয়ে, আমার অফিসের আশেপাশে, শহরের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করা হচ্ছে। গত ১৬ বছরের অনেক দুঃখ-কষ্ট আপনাদের জমা আছে। সেটা আমরা বুঝি। আমাদের যদি কাজ করতে না দেন তাহলে এই দুঃখ ঘোচানোর সকল পথ বন্ধ হয়ে থাকবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ, আমাদের কাজ করতে দিন। আপনাদের যা চাওয়া লিখিতভাবে আমাদের দিয়ে যান। আমরা আপনাদের বিপক্ষ দল নই। আইনসঙ্গতভাবে যা কিছু করার আমরা অবশ্যই করব। কিন্তু আমাদের ঘেরাও করে কাজে বাধা দেবেন না।’
সূত্র: প্রথম আলো।