।। নিউজ ডেস্ক ।।
কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি কমলেও কমছে না মানুষের দুর্ভোগ। ব্রহ্মপূত্র নদ ও দুধকুমার নদী এখনো বিপদসীমার উপরে অবস্থান করছে। ফলে এসব এলাকার মানুষ এখনো পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। হাঁটু বা কোমড় পানিতে তাদেরকে হাঁটাচলা করতে হচ্ছে। জ্বালানী সংকটের কারণে একবেলা রান্না করে দুবেলা খেয়ে দিন পার করছে তারা। এদিকে দীর্ঘদিন চারণভূমি তলিয়ে যাওয়ায় জমানো খড়ও শেষ হতে চলেছে। ফলে গোখাদ্যের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সেই সাথে পানি কমে যাওয়ায় তীব্র ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে।
উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়নের চরগুজিমারীর জওহরলাল মুচির স্ত্রী স্বপ্নারানী জানান, ‘স্বামী হার্টের অসুখে ভুগছে। দুই ছেলে ঢাকায় থাকে। একজন রিক্সা চালায় অপরজন মুচির কাজ করে। যা টাকা পায় তাদের চলে না। যতটুকু পারে সহযোগিতা করে। আজ একজনের কাছ থেকে আধা কেজি চাল ও কাঠালের বিচি নিয়েছি। সেটা দিয়ে দুপুরটা পার করে রাতের জন্য কিছু রেখেছি। এখন পর্যন্ত কেউ ত্রাণ সহায়তা করেনি।’
উলিপুরের হাতিয়া ও সাহেবের আলগা এবং চিলমারী রানীগঞ্জ ইউনিয়নসহ তিন ইউনিয়নের মানুষ বসবাস করেন হকের চরে। এখানে গত ১৫দিন ধরে ভাঙনের তান্ডব লীলায় ১১০টি বাড়ী নদীগর্ভে চলে গেছে। এরমধ্যে গুচ্ছগ্রামের ৬০ এবং বাইরের ৫০ ঘর। এছাড়া হকের চর সংলগ্ন চর বাগুয়া ও চর গুজিমারীতেও ভাঙন চলছে।
হকের চরের হাজেরা বেগম (৪৭) জানান, ‘একদিনের ভাঙনে ৩৫টি বাড়ি বিলিন হয়ে গেছে। আমরা গুচ্ছগ্রাম থেকে গুজিমারী গেছি কিন্তু সেখানে পানি ওঠায় আবার ভাঙন কবলিত জায়গায় চলে এসেছি। আমাদের কোন জমিজমা নেই। এখন যে কোথায় উঠি ঠিক করতে পারি নাই।’
সাহেবের আলগা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোজ্জাফর হোসেন বলেন, চলতি বন্যায় তার ইউনিয়নে ১৯৭ পরিবার নদী ভাঙনের শিকার হয়ে নি:স্ব হয়েছে। এরমধ্যে হকের চরে ৯০ পরিবার, দক্ষিণ নামাজের চরে ৪৭ পরিবার ও দৈ খাওয়ার চরে ৬০ পরিবার। তিনি আরও জানান, এই ইউনিয়নে প্রায় ৬ হাজার ৫০০ পরিবার এর মধ্যে ৫০০ পরিবার স্বচ্ছল। বাদবাকী সবাই কম বেশি গরিব। প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ পানিবন্দী। এখন পর্যন্ত ত্রাণ পেয়েছেন ২টন চাল আর ১০০প্যাকেট শুকনা খাবার। এরমধ্যে বিভাগীয় কমিশনার এসে বিতরণ করেছেন ২৯০ কেজি চাল আর উপজেলা পরিষদ থেকে ১৫০ প্যাকেট শুকনা খাবার। ফলে অনেকের কাছে ত্রাণ পৌছানো সম্ভব হয়নি।
হকের চরের আমজাদ আলীর তিন সন্তান শাহীন (১৭), আয়শা (১৫) ও সুমন (১২) আর স্ত্রীকে নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে হাঁটছেন। আপাতত আত্নিয়র বাড়িতে আশ্রয় নিবেন। এই হকের চরের মানুষ বন্যায় একদিন শূকনা খাবার ছাড়া আর কোন ত্রাণ তাদেও ভাগ্যে জোটেনি।
শাহাবুদ্দিন (৭০), হাজেরা বেওয়া (৬৫) কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, ২০১০ সাল থেকে এই চরে থাকি। ২০১৯ সালে সরকার গুচ্ছ গ্রামে ঘর দেয়। এই ঘর সব নদী খায়া নিলো। এলা মাথাগোজার ঠাই নাই। যাচ্ছেন দক্ষিণে চিলমারী উপজেলার রাণীগঞ্জ ইউনিয়নের এক চরে। তাদের দাবি সরকার যেন দ্রুততম সময়ে নতুন আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেদেন।
হাতিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল হোসেন বলেন, হকের চরটিকে ব্রক্ষপূত্র ভাঙছে ইউ আকারে। গোটা চরটি পর্যায়ক্রমে নদীর পেটে যাচ্ছে। এই চরের অবস্থান হাতিয়া ইউনিয়ন, নয়ারহাট, সাহেবের আলগা ও রাণীগঞ্জের সীমানা এলাকা। এই চরে এই চার ইউনিয়নের লোক বিভিন্ন সময় নদী ভাঙনের শিকার হয়ে আশ্রয় নেয়। ফলে কোন ইউনিয়ন পরিষদ এদের খুব একটা খোজ খবর রাখে না। ফলে এরা বরাবরই অবহেলিত থাকছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জেলা প্রশাসকের দপ্তরের কন্ট্রোল রুমের বরাতে জানান, জেলার ৯ উপজেলা ৫৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে ৬৬২ দশমিক ৭৫ বর্গ কি: মিটার। বন্যা আক্রান্ত পরিবারের সংখ্যা ৩৭ হাজার ১০০টি। নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়েছে ৪৫৮টি পরিবার। ফসলের ক্ষতি হয়েছে ৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমির। বন্যার্তদের সেবায় ৮৩টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। জেলার ৯ উপজেলায় ১৩০০ মে. টন চাল ও ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া দেয়া হয়েছে শূকনা খাবার বরাদ্দ। এখন পর্যন্ত ৫৮৭ মে.টন চাল, ৩২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা এবং ২৪ হাজার ৩৬০ প্যাকেট শূকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। বিতরণ কার্যক্রম চলমান আছে। বন্যাা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় মানুষজন ঘরে ফিরতে শুরু করেছে।
এছাড়া বন্যার্তদের মাঝে ৫লাখ ১১ হাজার ৬৫০টি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ২০ হাজার ১২৬টি জেরিকেন সরবরাহ, নলকূপ মেরামত করা হয়েছে ৫৫টি, নতুন নলকূপ স্থাপন ৬টি এবং ল্যাট্রিন স্থাপন ৬টি করা হয়। এছাড়া হাইজিন কিটস বক্স ৬৫টি বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।