।। নিউজ ডেস্ক ।।
সত্তরোদ্ধ জালাল উদ্দিন, টানা ১০দিন থেকে পুরো পরিবার নিয়ে পানিবন্ধী জীবন কাটাচ্ছে। ঘরে যে জমানো চাল ছিল তাও এ কয়েকদিনে শেষ হয়েছে। এক প্রতিবেশীর কাছে টাকা ধার নিয়ে পরিবারের খাবার যোগাচ্ছে। দিনে একবার রান্না হয় বাড়িতে। অন্য সময় হয় শুকনো খাবার না হয় উপোস করে থাকতে হয়। তারা দিন রাতে মিলে এক বেলা খায়। দুদিন আগে তাদের ওয়াডের মেম্বার ৫ কেজি চাল দিয়েছিল। তাদিয়ে দুপুর ও রাতে ডাল দিয়ে ভাত খেয়েছিল। এ অবস্থা শুধু জালাল উদ্দিনের পরিবারের নয় ব্রক্ষপুত্র নদের অববাহিকায় কালির আলগা মৌজার মন্ডল পাড়া গ্রামের ৫০ পরিবারের। কি অবর্ণনীয় কষ্টে চলছে ব্রক্ষপুত্র দুধকমোর ধরলা,তিস্তা পারের পানি বন্দী মানুষরা। টানা ১০ দিনের বেশী সময় চলছে এ অবস্থা। আজও দুর্গম চর-দ্বীপচরের মানুষের ঘরে এবং আঙ্গিনায় হাটু পানি।
কুড়িগ্রাম দুধকুমোর নদীর পারে যাত্রাপুর ইউনিয়ন। বুধবার সকালে থেকে ইউনিয়নের দুর্গম চরাঞ্চল ঘুরিয়ে বেড়িয়েছি দেখেছি মানুষের কি দুর্ভোগ। পানি বন্দী থাকতে থাকতে শুকিয়ে গেছে। মন্ডলপাড়া গ্রামের আব্দুল জলিল (৭২)। একজন গৃহস্থ। তার পরিবারে ৮জন মানুষ। পুরোপুরি কৃষির উপর নির্ভরশীল। এক বিঘা জমিতে চিনা ও একবিঘা জমিতে কাউন আবাদ করেছিল। এখনও পানির নীচে তলিয়ে রয়েছে। দুটি আবাদেই পানিতে থাকতে থাকতে নষ্ট হয়ে গেছে। গরু ছাগল গুলো বাঁধের উপর রেখেছে। চরম খাদ্য সংকট চলছে গবাদী পশু গুলির। বাঁশপাতা ও কলার দিয়ে কোন রকমে তাদের জীবন টাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। শুধু তারা নয় আশে পাশের কালির আলগা, ৮নং ওয়াডের গোয়ালপুরী, তিনহাজারী, উত্তরমন্ডলপাড়া, চরপার্বতীপুর গ্রামসহ ১০টি গ্রামে কয়েক হাজার মানুষ পানি বন্দী জীবন কাটাচ্ছে। বাড়ীর নলকুপ-পায়খানা তলে গেছে। রাতে বাচ্চাদের নিয়ে প্রাকৃতিক ডাক সারা দিলে চরম কষ্টে পড়তে হয়। কিনতু উপায় নেই। এখনও কেউ ত্রান পায়নি সে অভিযোগ সকলেই করলেন। বন্যা কবলিত এ জেলার ৪০৫টি চর-দ্বীপচরের ২শগ্রামের একই অবস্থা।
পাশ্ববর্তী গ্রামের শিবেরপাচী গ্রামের দিনমজুর মোন্নাফ আলী (৫০) জানান কয়েকদিন থেকে সন্তান দের নিয়ে ঘরে থাকতে থাকতে অতিষ্ট হয়ে গেছি। ছেলে-মেয়রা খাদ্য কষ্টে কান্নাকাটি করে। ধার করেছি দুই হাজার টাকা তাই দিয়ে চলছে। তার মেয়ে তাসমিন মাঠে যাবার জন্য কান্না কাটি করে।
গোয়ালপুরি গ্রামের যবুক দুলাল মোল্লা (২৪) ব্রক্ষপুত্র নদে মাছ ধরে। এ দিয়ে সংসার চালায়। বন্যার কারণে মাছ ধরা বন্ধ। চরম কষ্টে স্ত্রী সুফিয়া বেগম আর তিন সন্তান আর মাকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। কোন ত্রান সাহায্য পায়নি। জানে না পাবে কিনা। পানিতে থাকতে থাকতে তার সন্তান দের জ¦র,সর্দি আর হাতে পায়ে ঘা হয়েছে। খুব কষ্টে পড়েছে ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে। এমন অবস্থা কতদিন চলবে জানেনা। সকালে শুকনো চিড়া আর বিস্কুট দিয়ে নাস্তা সেরেছে সবাই। রাতে এই খাবারেই খাবে তারা। তিনি আরও জানালেন, ‘নলকুপ ডুবে গেছে। সেই পানি সবাই খাচ্ছি। পায়খানা তলে গেছে বয়ষ্ক মানুষ আর ছোট বাচ্চাদের খুব সমস্যা হচ্ছে।
শিবের পাচি গ্রামের মমিনুল (২৫) জানান তাার এলাকার সবাই শ্রমজীবি মানুষ। ঢাকা সহ বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করে। ১৫ দিন থেকে কোন কাজ নেই। ঘরের খাবার ও সঞ্চয়ের যে টাকা তাও শেষ হয়েছে গত ৫দিন আগে। মানুষের কাছে ধারদেনা করে চলছে। কোন সরকারী ত্রান পায়নি এখন পর্যন্ত।
নৌকার মাঝি নুরনবীন (২২) তাদের বাড়ী কিছুটা উচু। উঠোন ভর্তি পানি। ঘরগুলোতে এখনো পানি ঢোকেনি। দুটো গরু ছিল বাঁধের সড়কে রাখা হয়েছে। তিনি জানান, গরুর খাদ্য নিয়া খুব দুশ্চিন্তায় আছি। আমরাই খাবার পাই না। গরুর খাওয়াই কেমনি। খাবার অভাবে গরু দুটা শুকিয়ে যাচ্ছে। তাদের এলাকায় প্রায় অর্ধশতাধিক বাড়ীতে পানি উঠেছিল। পানি কমতে শুরু করেছে। ঘরে কাদা। থাকার উপযোগী করতে ৭ দিন সময় লাগবে।
যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল গফুর জানান তার ইউনিয়েনে ধরলা ব্রক্ষপুত্র ও দুধকুমোর নদ-নদী প্রবাহিত হয়েছে। অধিকাংশ মৌজা পানির নীচে তলিয়ে রয়েছে। আসলে পর্যায়ক্রমে ত্রান দেওয়ার কারণে কিছুটা সমস্যা হয়। তবে অধিকাংশ মানুষ ত্রান পেয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন সুত্রে জানা গেছে বানভাসীদের জন্য ৯ উপজেলায় ৩৯৭ মেট্রিক টন চাল ও ২১ লক্ষ ৮৫ হাজার টাকা বিতরণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, সরকারের নির্দেশনায় বন্যার্তদের পাশে থেকে দুর্ভোগ কমাতে সবধরনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। আমাদের প্রচুর খাদ্য ও শুকনো খাবার মজুদ রয়েছে।