।। নিউজ ডেস্ক ।।
কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক রুপ ধারণ করেছে। টানা ৬দিন ব্যাপী স্থায়ী বন্যায় ব্রহ্মপূত্র নদী তীরবর্তী এলাকার হাজার হাজার বন্যা প্লাবিত মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছে। প্রাথমিকভাবে মানুষ যেসব উঁচু স্থানে গবাদিপশু রেখেছে, গত দু’দিনে হুহু করে সেসব স্থানে পানি ওঠায় গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে পানিবন্দি মানুষ। জীবন বাঁচাতে অনেকে নিজস্ব নৌকায়, উঁচু রাস্তায়, ফ্লাড শেল্টার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মেইন ল্যান্ডে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। শনিবার (৬ জুলাই) নাগেশ্বরীতে দুধকুমার নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে নতুন করে ১২ গ্রামের ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বর্তমানে জেলায় পানিবন্দি লোকের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রাফসান জানি জানান, শনিবার বিকালে ব্রম্মপুত্রের নুনখাওয়া পয়েন্টে ৬১ স. মি., হাতিয়া পয়েন্টে ৬৮ সেন্টিমিটার ও চিলমারী পয়েন্টে ৭০সেন্টিমিটার, ধরলা নদীর কুড়িগ্রাম ব্রীজ পয়েন্টে ১০ সেন্টিমিটার ও তালুক শিমুলবাড়ী পয়েন্টে ২৫ সেন্টিমিটার এবং দুধকুমার নদীর পাটেশ্বরী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আগামী কয়েকদিন এ পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে বলে জানান।
বন্যার পানির তোড়ে শনিবার বিকালে নাগেশ্বরী উপজেলার মিয়াপাড়া নামক স্থানে দুধকুমার নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১০০ মিটার ভেঙ্গে যাওয়ায় পার্শ্ববর্তী ১২ গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়ে কয়েক হাজার মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, গত ৫দিন ধরে নৌকায় স্ত্রী, ছেলে ও ২ নাতিকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়নের গুজিমারী গ্রামের শামসুল আলম। তিনি জানান, ঘরের আসবাবপত্র, চাল-ডাল, কাপড়-চোপড় ও মূল্যবান জিনিসপত্র যাতে হারিয়ে না যায় এজন্য নৌকায় আশ্রয় নিয়েছি। সারাদিন বৃষ্টির কারণে কিছু রান্নাবান্নাও করতে পারছি না। খুব সমস্যায় আছি।
একই উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের চর বাগুয়ার মনসুর আলী জানান, এখন পর্যন্ত কেউ খোঁজ খবর নিতে আসে নাই। চুলা বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় দুপুর গড়িয়ে গেল তবু পেটে কিছু পরেনি। একই উপজেলার হকের চরের মতিউর জানান, ছোট মেয়েডা অসুস্থ্য। কোন ডাক্তার পাইতাছি না। ঝারফুঁক দিয়া রইছে।
সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের কালির আলগা গ্রামের ছমিরণ জানান, খোলা নৌকায় গাদাগাদি কইরা আছি। সরকারিভাবে চাল-ডাল-তেল পাইলেও লাকড়ির অভাবে আন্দোন বান্দোন করবার পারতাছি না। পেলাপান খুব কান্না কাটি করতাছে।
কুড়িগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. মঞ্জুর-এ-মুর্শেদ জানান, ইউনিয়ন পর্যায়ে ৮৩টি মেডিকেল টিম বন্যা কবলিত এলাকায় কাজ করছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে কার্যত বন্যা এলাকায় কাউকে দেখা মেলেনি। ওই সব গ্রামে গত ৫দিন ধরে কোন মেডিকেল টিম খোঁজ খবর নেয়নি বলে বানভাসীরা জানিয়েছেন।
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, এখন পর্যন্ত ৬ হাজার ৬৬০ হেক্টর ফসলি জমি, বীজতলা ও শাকসবজি বন্যার পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। পানি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির হিসেব পাওয়া যাবে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নবেজ উদ্দিন সরকার জানান, ১৪৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে। পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও উলিপুরের বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের বেগম নুরুন্নাহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩২টি এবং নাগেশ্বরীর বেরুবাড়ী ইউনিয়নের সবুজ পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩৫টি বানভাসী পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।
জেলা শিক্ষা অফিসার শামসুল আলম জানান, চলমান বন্যায় ১০৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরমধ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ের ৭১টি স্কুল, ৩২টি মাদরাসা ও ৬টি কলেজ রয়েছে। তিনি আরো জানান, এছাড়াও চিলমারী নটারকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়, নাগেশ্বরী সরকালি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ভিতরবন্দ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ডিগদারি নুনখাওয়া দাখির মাদরাসা, রাজিবপুর কোদালকাটি উচ্চ বিদ্যালয় ও চর নেওয়াশী উচ্চ বিদ্যালয়ে বানভাসী মানুষ গরু-ছাগল নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরণের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। কোথাও কোন সমস্যা থাকলে আমাদের নজরে দেয়া হলে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেবো। আমরা মিলিতভাবে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে বদ্ধ পরিকর। এখন পর্যন্ত দুর্গতদের জন্য ২৯১ ম. টন চাল, ২১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বন্যা আক্রান্ত এলাকার এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের যেকোন সমস্যা হলে ইউএনও অথবা জেলা প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।