জরীফ উদ্দীন:
আব্দুল খালেক ফারুক একজন প্রগতিশীল শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মী। পেশায় সাংবাদিক। সংবাদের জন্য ছুটে বেড়ান বিভিন্ন স্থানে। এই অভিজ্ঞতাই তার গল্পের মূল উপজীব্য। চারপাশে ঘটে যাওয়া জীবনের গল্পই বলতে চান তিনি। তার গল্পে সুনিপুণ ভাবে ফুটে উঠেছে সমাজের কূপমণ্ডূকতা, হিংসা, ধর্মান্ধতা, লোভ, অন্ধবিশ্বাস, অপরাজনীতি, শিক্ষা ব্যবসা, প্রেম-বিচ্ছেদ। গল্পগুলো পড়তে পড়তে হাড়িয়ে যেতে হবে সমাজের রন্ধে রন্ধে। পড়তে পড়তে মনে হবে চোখের সামনে দেখতেছি ঘটে যাওয়া দৃশ্যপট। প্রথমগল্প “কাঁটাতারে ঝুলে আছে ফেলানী” ফেলানীর রাত শেষ হলেই বিয়ে খালাতো ভাই আমজাদের সঙ্গে। তাই রাতের আধার থাকতেই ফেলানী তার বাবার সঙ্গে সিমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আচ্ছিলেন দালালদের সাহায্যে। বাবা কাঁটাতারে উপর পার হচ্ছেন ফেলানী তার পিছে। হঠাৎ গুলির শব্দ…….। এমনি লোমহর্ষক সত্য ঘটনার বহিঃপ্রকাশ। তারপর ফেলানীকে নিয়ে দলীয় রাজনীতির চেষ্টা, আব্রাহাম স্যারের ফেলানী হত্যার ঝুলুন্ত কেস লড়া সব মিলিয়ে একটি অসাধারণ গল্প।
দ্বিতীয় গল্প রোগমুক্তি। ধর্মান্ধতায় ছেড়ে গেছে সমাজ। আর এই সুযোগে নামধারী মাওলানারা সহজ সরল মানুষ ঠকিয়ে করছে ধর্ম ব্যবসা। কারো কঠিন রোগ হলে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে মান্নত করে বিভিন্ন মাদরাসা, মসজিদ কিংবা মাজারে অথবা ওয়াজ মাহফিল। এরকম এক মান্নতে ওয়াজ মাহফিল চলাকালীন সময় যার রোগ মুক্তির জন্য এই মাহফিল সে দুনিয়া ত্যাগ করে পাড়ি জমায় পরপারে।
বৃদ্ধ মৃধা ভাতিজার জন্য কনে দেখতে গিয়ে নিজেই বিয়ে করার সীদ্ধান্ত নেন তার মৃত বৌয়ের মতো কনে হওয়ায়। এক রাতের আধারে নতুন বৌকে ঘরে তুলতে গেলে সমস্যা দেখা দেয়। নিজের বাড়িতে বৌকে ঘরে তুলতে দেয় না ছেলেরা। এক সময় ঘরে তুলতে দিলেও মৃধার মনটা অনেক কিছই ভাবে রাতের ঘুম না হওয়ায়। বৌ অন্তঃসত্তা হলে বৌ ও নতুন অতিথির জন্য আলাদা বাড়ি যার নাম প্রাণ কুঠির তৈরির আয়োজন। যাদের জন্য প্রাণ কুঠির নির্মাণ করতে শুরু করেন সেই বৌ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। সন্তানের অবস্থাও…..।
তা যাই হউক এত কিছুর পরও লেখক কিন্তু প্রেমহীন নন যা ‘মীরা এবং’ গল্পটি পড়লেই মনে হবে। একটা ছাব্বিশ বছরের দরিদ্র ঘরের বেকার ছেলের যা অবস্থা তাই ফুঁটে উঠে এই গল্পটিতে । মীরা একদিন চলে যায় বাবার চাকরির স্থান বদল ও তার উজ্জ্বল জীবনের প্রত্যাশায় ইউনিভার্সিটি পড়তে। এরপর মীরা চায় তাদের আবার দেখা হউক। সত্যিই কি তাদের আবার দেখা হয়? হয়ত পৃথিবীতে যারা মহান তারা অনেক কিছুই তুচ্ছ মনে করে নিজের দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে অন্যকে সুখী দেখতে চান। লেখক এই গল্পে তাই করেন।
আমাদের দেশের এক শ্রেণির মানুষ শিক্ষাকে নিয়ে করছে জমজমাট ব্যবসা। প্রশাসন নিশ্চুপ। নিশ্চুপ প্রগতিবাদী ভন্ডরা। কারা এর প্রতিবাদ করবে? প্রতিবাদীরাই ভুক্তভোগী।
বিবিসি বিড়ম্বনায় ফুটে উঠেছে সমাজের মানুষ বিরক্তকারী কীটদের আসল চেহারা। মানুষ কত নিষ্টুর, স্বার্থবাদী, ধান্দাবাজ, পরশ্রীকাতরতা তা প্রতিদন্ধী না পড়লেই বুঝা যাবে না।
আজ আমাদের দেশের, দেশের সাধারণ মানুষের উন্নতি না হলেও উন্নতির কমতি নেই নেতাদের। তারা সাধারণ জনগণকে বছরের পর বছর ঠকিয়ে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। এমনি বর্তমান রাজনীতির পেক্ষাপটে রচিত ‘ভকারু’ গল্পটি যেন গল্প নয় আমাদের দেশের রাজনীতি ও নেতাদের হুবাহু কপি।
শেষ গল্প একাব্বর আলীর পদ্মপুরাণ গ্রামের এক প্রতিচ্ছবির নাম। বাসলি নামের এক রোগের কবিরাজি করা অবস্থায় কবিরাজের ছেলে সাপের কামড় খেয়ে মারা যায়। কিন্তু তার আগে ঘটনা?
এরক নয়টি ভিন্ন স্বাদের নয়টি গল্পে সাজানো “কাঁটাতারে ঝুলে আছে ফেলানী”। গল্পগ্রন্থে লেখক সমাজের চোখে, দেশের চোখে, দেশের প্রগতিবাদী মানুষের চোখে বুড়ো অাঙ্গুল দেখিয়ে দিয়েছেন অতন্ত সাহসিকতায়। যা একজন বুদ্ধ পাঠক অবলীলায় স্বীকার করবে।
যারা ফেলানী সম্পর্কে জানতে চান, জানতে চান কুড়িগ্রামের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মান্ধতা আর সাধারণ মানুষের জীবনাচরণ তাদের বইটি পড়া আমি একান্ত প্রয়োজন। আপনি যদি বইটি না পড়েন তাহলে অনেক কিছুই মিস করবেন।