মোঃ রিফাজুল হক কাননঃ
ভাওয়াইয়া গানের আতুর ঘর, সৈয়দ শামসুল হকের পিতৃভূমি, ২০টি নদী ও ৪২০টি চর বেষ্টিত জেলা কুড়িগ্রাম। গ্রীষ্মের দাবদাহ, বর্ষায় নদী গুলোর দুকূল ছাপিয়ে বন্যা, শরতে নীল আকাশের সাথে সবুজ কাশবনের মাখামাখি আর শীতে হার কাঁপানো ঠান্ডার মাঝে জীবনের হিসাব নিকাশ করে দিনকাটে এ এলাকার মানুষের। এ জেলার গর্ব করার মতো ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থাকলেও বন্যা, খরা,নদীভাঙ্গন সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করে বাংলাদেশের মানচিত্রে সবচেয়ে অনুন্নত ও অবহেলিত জেলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সামাজিক,রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধিত হলেও স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও কুড়িগ্রাম জেলার মানুষের ভাগ্যের তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি। ২০০৫ সালের পূর্বে ও পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় কুড়িগ্রামকে মঙ্গা কবলিত এলাকা হিসেবে অবহিত করা হলেও পরবর্তী সময়ে মঙ্গার নাম পরিবর্তন করে দেশের সবচেয়ে গরীব জেলা হিসেবে অাখ্যায়িত করা হয় যা এ এলাকার মানুষ তথা একটি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের জন্য অপমান ও লজ্জার। ২০১৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের পরিসংখ্যান বুরো (বিবিএস), বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচি (ডাবলুবিইউএফপি) যৌথভাবে যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখানো হয়েছে, কুড়িগ্রামে দারিদ্রের হার ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এ পরিসংখ্যানে আরো দেখানো হয়েছে যে, কুড়িগ্রামের ২০ লাখ মানুষের প্রায় ১৩ লাখ মানুষ দারিদ্র এদের মধ্যে ৯ লাখ মানুষ অতি দরিদ্র সীমার নিচে বাস করে।
বর্তমান সরকার দেশের কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে ব্যপক উন্নয়ন স্বাধন করার পাশাপাশি বিভিন্ন অর্থৈতিক কার্যক্রম গ্রহন করায়, মানুষের মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ফলে দেশের দারিদ্র্যের হার ৪৫ শতাংশ থেকে কমে ২৪.৮ শতাংশ হয়েছে। অথচ স্বাধীনতার ৪৫বছর পরেও কুড়িগ্রাম জেলার ৬৩.৭ শতাংশ দরিদ্র মানুষের বাস ও এ অবস্থার পরিবর্তনে কোন টেকসই পদক্ষেপ গ্রহন না করা এখানকার মানুষদের ভাবিয়ে তুলছে। এছাড়াও এ জেলার মানুষ এখনো পর্যাপ্ত সরকারি ব্যাংকের সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকায় বিভিন এনজিও থেকে উচ্চ সুদে ঋণ গ্রহন করতে বাধ্য হচ্ছে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক কতৃক প্রকাশিত সর্বশেষ আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সূচক ২০১৬ (আইএফআই) তালিকায় বাংলাদেশে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে এই জেলাটি। বর্তমান সরকার ২০২১ সালকে সামনে রেখে ভিশন -২০২১ বাস্তবায়নের যে রুপরেখা প্রদান করেছেন সেখানে দেশের দারিদ্রের হার ৪৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে কমিয়ে আনার কথা বলা হলেও কুড়িগ্রামের এ উচ্চ দারিদ্রের হার ভিশন -২০২১ লক্ষ অর্জনে বিষফোড় হিসেবে দেখা দিয়েছে। এক তথ্য মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকে শুধুমাত্র নোয়াখালী জেলার সঞ্চয় রয়েছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা সেখানে কুড়িগ্রামের মাত্র ৪ হাজার কোটি টাকা।
ব্যাংকিং সেবা গ্রহনে এখনো জেলাটি বাংলাদেশে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। এমন কি কিছু কিছু স্থান থেকে বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকের শাখাও তুলে নেয়া হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, দুধকুমারসহ অন্যান্য নদীর নাব্যতার অভাবে কুড়িগ্রাম জেলা প্রতি বছর ভয়াবহ বন্যা ও নদীভাঙ্গনের স্বীকার হয়। এর ফলে প্রতি বছর হারিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার হেক্টর আবাদি জমিসহ অনেকের সাজানো স্বপ্ন। কুড়িগ্রামে প্রায় ৪৫ হাজার পরিবার সরকারী, এনজিও ও অন্যান্য কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠনের নির্মাণাধীন বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। ২০১৩ সালে এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কুড়িগ্রাম জেলার ২ লাখ ২৮ হাজার ৪৬০ হেক্টর জমি চরাঞ্চলে রূপান্তরিত হয়েছে। এর পরিমাণ কুড়িগ্রামের মোট ভূ-ভাগের অর্ধেকেরও বেশি। আর এর মধ্যে ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা ৫ থেকে ৬ লাখ, যার মধ্যে ৪৫ ভাগ সম্পূর্ণ ভূমিহীন, ১৯ ভাগ পরিবার প্রান্তিক কৃষক, ১১ ভাগ নিম্নবিত্তের কৃষক আর ২৫ ভাগ পরিবার বিভিন্ন স্তরে রয়েছে। বাংলাদেশে মাথাপিছু গড় আবাদি জমির পরিমাণ দশমিক ২৫ হ্ক্টের (পরিসংখ্যান ২০০৩) হলেও কুড়িগ্রামের মানুষের মাথাপিছু আবাদি জমির পরিমান প্রায় দশমিক ১১ হেক্টর। তাই কুড়িগ্রামকে শতভাগ কৃষিনির্ভর জেলাও বলা যায় না। বাংলাদেশ কয়েক বছর থেকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে গেলেও কুড়িগ্রাম জেলার অধিকাংশ মানুষ এখনো তীব্র খাদ্য সংকটে ভোগে।
সম্প্রতি ইন্টিগ্রেটেড ফুট সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন(আইপিসি) এক জরিপে দেখিয়েছেন বাংলাদেশে তীব্র খাদ্য সংকটে থাকা জেলা গুলোর অন্যতম হলো কুড়িগ্রাম। ব্রহ্মপুত্র তিস্তা ও দুধকুমোর নদীবিধৌত জেলা কুড়িগ্রামের ২০লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই খাদ্য সংকটে থাকে। এক জরিপে দেখা যায় দেশের মানুষ বছরে গড়ে প্রায় ১২ কেজি আমিষ গ্রহন করলেও কুড়িগ্রামের মানুষ গড়ে আমিষ গ্রহন করে ৭.৫ কেজি ফলে এ এর প্রভাব পড়ছে শিশু স্বাস্থের উপর। সারা দেশে কম ওজনের শিশু জন্মগ্রহনের হার ১৭.৫ শতাংশ হলেও কুড়িগ্রাম জেলায় ৩৮.৭ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় আমন,বোরো ও আলু উৎপাদনে এখনো পিছিয়ে রয়েছে এই জেলাটি । কুড়িগ্রামেই বাংলাদেশের একমাত্র সীমান্ত জেলা যার সাথে ভারতের তিনটি প্রদেশ (আসাম , পশ্চিমবঙ্গ,মেঘা লয়) সম্পৃক্ত। সেভেন সিস্টার্স, নেপাল, ভুটান এমনকি চিনের সাথেও বানিজ্য বিস্তারে এ জেলাটি ভৌগোলিক ভাবে এগিয়ে থাকলেও এ জেলায় রয়েছে শিল্পাঞ্চলের অভাব, সরকারী বেসরকারী বিনিয়োগের অভাব, যোগাযোগ, শিক্ষা ও অবোকাঠামোগত উন্নয়নের অভাব। এ কারণে অনেকে মাদক চোরাচালানের পাশাপাশি অন্যান্য জেলা তথা বিভাগীয় শহরগুলোতে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে স্থানীয় উৎপাদিত পণ্য সঠিকভাবে বাজারজাত করতে পারেনা কৃষকরা । ফলে মাথাপিছু আয়, দারিদ্রের হার শিক্ষা ও পুষ্টি গ্রহণের দিক থেকে কুড়িগ্রাম বাংলাদেশে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১৪৬৬ ডলার হলেও কুড়িগ্রাম জেলার মানুষের মাথাপিছু আয় ৮২৮ ডলার।
বর্তমান উন্নয়নের সরকার দেশের সার্বিক উন্নয়নে দক্ষিণ বঙ্গে চলমান ফাসট্রাক অনেক প্রকল্প গ্রহন করায় মানুষের সার্বিক মাথাপিছু আয় জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভবনা সৃষ্টি হবে কিন্তু বৃহত্তর রংপুর তথা কুড়িগ্রামের মানুষের মাথাপিছু আয়ের গানিতিক বৃদ্ধির হার এ এলাকাকে পিছিয়ে রাখছে। সরকার কুড়িগ্রামের উন্নয়নে সোনাহাট স্থল বন্দর নির্মাণ ও চিলমারী বন্দর পুনরায় চালুর যে সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছেন সেটি কুড়িগ্রামের টেকসই উন্নয়নে কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে সেটাও ভাবা দরকার। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। প্রতি বছর নদীভাঙ্গনের ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও নাব্যতা হ্রাস একটি সাধারণ ঘটনায় পরিনত হয়েছে। সরকার চিলমারী বন্দরকে একটি আন্তর্জাতিক নৌ বন্দরে পরিনত করার লক্ষে চিলমারী টু মংলা বন্দর পর্যন্ত নদী ড্রেজিং করার যে সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে সেটাকে কুড়িগ্রামবাসি অভিনন্দন জানালেও বন্দর কেন্দ্রিক শিল্প কারখানা স্থাপনের অভাব অনুভব করছে।
অন্যদিকে দারিদ্রতা, যোগাযোগব্যবস্থার অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সীমান্তকেন্দ্রিক জেলা হওযায় উচ্চ শিক্ষা লাভে এ এলাকার মানুষ এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। দেশে মানুষের গড় স্বাক্ষরতার হার ৬৫ শতাংশ হলেও কুড়িগ্রামে সাক্ষরতার হার মাত্র ৩৬.৯৯ শতাংশ । বর্তমান সরকার নি:স্বন্দেহে একটি শিক্ষা বান্ধব সরকার। সরকার সারা দেশে উপজেলা পর্যায়ে একটি কলেজ ও একটি স্কুল কে সরকারি করনের ধারাবাহিকতায় কুড়িগ্রামেও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সরকারি করণ করেছেন ফলে এ জেলার মানুষ আনন্দিত কিন্তু শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে থাকা এ জেলার মানুষের জন্য তা অপর্যাপ্ত । দেশের প্রায় জেলায় মেডিক্যাল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়,বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও কুড়িগ্রামে এর একটিও নেই। এর ফলে উচ্চ শিক্ষা বিশেষ করে নারীরা উচ্চ শিক্ষা অর্জনেঅনেক পিছিয়ে রয়েছে। কুড়িগ্রামের মাটি ও মানুষের সংগঠন গণকমিটি এক অনুসন্ধানে দেখিয়েছে বিদেশে প্রবাসী শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে ২০০৪-২০১৪ পর্যন্ত জেলাগুলোর গড় ছিল ৭৮৭১১ জন অথচ কুড়িগ্রাম জেলায় তা মাত্র ৯২৪৩ জন। দেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে বিদেশে প্রবাসী শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রেও কুড়িগ্রাম অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
কুড়িগ্রাম থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৫০টির বেশি বাস বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচল করে যার ৭৫% যাত্রীই কৃষি, শিল্প ও পরিবহন শ্রমিক। এ জেলায় দেশের সবচেয়ে সস্তা মূল্যে শ্রম পাওয়া গেলেও এখানে গড়ে ওঠেনি বড় ও মাঝারি আকারের শিল্প কারখানা। দেশে বড় ও মাঝারি শিল্প (২০০০-০১) পর্যন্ত জেলাগুলোতে গড় প্রায় ৩৮৭টি হলেও কুড়িগ্রামে মাত্র ১০টি। এত কম সংখ্যক শিল্প এলাকার উন্নয়নে তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারছেনা। কুড়িগ্রামের এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মুলধারায় নিয়ে আসতে তিনটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেঃ
১. উচ্চ শিক্ষা বিস্তারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা।
২. রপ্তানিমুখী অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন।
৩. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন।
উন্নয়ন ও উন্নয়নের কথা বলে অনেকে উন্নয়নের ইতিহাস রচনা করলেও বাস্তবে কুড়িগ্রামের উন্নয়নের ইতিহাস বঞ্চনার ইতিহাস। কুড়িগ্রামের হাজার বছরের ইতিহাস নয় ১৯৪৭ সালের পূর্বেই কুড়িগ্রামে বিমানবন্দর ১টি, রেলওয়ে সদর দপ্তর ১টি, জাহাজ তৈরির কারখানাসহ নৌ-বন্দর ছিল ২টি। এখন ২০১৬ সালে তার একটিও নেই তবে একটি নৌবন্দর পুনরায় চালুর কার্যক্রম সম্প্রতি শুরু হয়েছে মাত্র। ১৯৬৫ সালের আগে লালমনিরহাট-ভুরু ঙ্গামারী রুটে রেল চলাচল করলেও বর্তমানে তা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। ১৯৮৬ সালের আগে চিলমারী টু বাহাদুরাবাদ ফেরী ও কার্গো চলাচল করলেও এখন সেটি বন্ধ। ১৯৯০ সালের আগে রমনা রুটে ৪টি ট্রেন চলাচল করত, বর্তমানে একটি লোকাল ট্রেন কচ্চপ গতিতে চলাচল করছে। নাগেশ্বরীতে সরকারি হাসপাতাল বন্ধহয়ে যাওয়ার মত ঘটনাও আছে কুড়িগ্রামে। কুড়িগ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের ঘামে ভেজা টাকার ট্যাক্স বৃদ্ধি পাবে অথচ তাদের সেবা হারিয়ে যাবে,তারা দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জেলার উপাধী গ্রহন করব তা হতে পারেনা। অনেকে মনেকরেন, বর্তমান সরকার কুড়িগ্রামের উন্নয়নে বিশেষ আগ্রহী হলেও সরকারকে কুড়িগ্রামের উন্নয়নে সঠিক পরিকল্পনা প্রদান ও উন্নয়ন প্রশ্নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়হীনতা কুড়িগ্রামকে অনেক পিছিয়ে রেখেছে।
গত ৭ ডিসেম্বর গণকমিটি কর্তৃক ” কুড়িগ্রামের উন্নয়ন ভাবনা ” শীর্ষক আলোচনা সভায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান বিশিষ্ঠ অর্থনীতিবীদ জনাব আইনুল হক কুড়িগ্রামের উন্নয়নে সঠিক পরিকল্পনার অভাব ও নেতাদের ব্যর্থতাকে এগিয়ে রাখেন। অন্য বক্তব্যে মাননীয় সংসদ সদস্য লিলি চৌধুরী কুড়িগ্রামের উন্নয়নের জন্য সংগঠিত জনগনের অভাবের কথা তুলে ধরেন। সুশীল সমাজের প্রতিনিধি (সাংবাদিক, শিক্ষক, সংগঠক, গবেষকসহ অন্যান্য পেশাজীবী) দের কুড়িগ্রাম সম্পর্কে, কুড়িগ্রামের উন্নয়ন সম্পর্কে তাদের সুচিন্তিত মতামত লিখনির মাধ্যমে তুলে ধরে স্থানীয় মানুষদের সচেতন ও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে কাজ করা দরকার। সুশীল সমাজকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সরবরাহ করে সিদ্ধান্ত গ্রহনে সহায়তা করার পাশাপাশি উন্নয়নের লক্ষে কখনো কখনো চাপসৃষ্টিকারি গুষ্টির ভূমিকাও পালন করা দরকার।
এছাড়া কুড়িগ্রামের উন্নয়নে ভুমিকা রাখতেপারে এমন কয়েকটি বিষয়ঃ
১. সরকার কর্ণফুলী নদীর পর জামালপুরে ফুলছড়ি ঘাটে দেশের দ্বিতীয় ট্যানেল নির্মাণের একটি পরিকল্পনা গ্রহনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছেন। তাই জামালপুর-গাইবান্ধা- কুড়িগ্রাম একটি নতুন রুট তৈয়রির সম্ভবনা থেকে যায়। সম্ভব্য এই রুটের উপযুক্ত ব্যাবহার অদূর ভবিষ্যতে কুড়িগ্রামের উন্নয়ন তথা বন্দর গুলো সচল রাখতে গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাছাড়া ঢাকা-কুড়িগ্রাম- চিলমারী রুটে আন্তঃনগর ট্রেন চালু ও চিলমারী- রৌমারী-রাজীবপুর নৌ রুটে লঞ্চ চালুর বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে কাজ করতে হবে।
২. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কুড়িগ্রামে সরকারি ও বেসরকারি উদ্দ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আশ্বাস প্রদান করেছেন। তাই বেসরকারি উদ্দ্যোগতাদের এ বিষয়ে উৎসাহিত করার পাশাপাশি পিছিয়ে থাকা এ এলাকার মানুষের উচ্চ শিক্ষা লাভে পুরোপুরি সরকারি অনুদানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. কুড়িগ্রাম জেলার মোট আয়তনের প্রায় ২২% হলো চর। ২০টি নদীর প্রায় ৪২০ টি চরের উন্নয়ন ছাড়া কুড়িগ্রামের উন্নয়ন অসম্ভব। বর্তমান সরকার চরের উন্নয়নে প্রতিবছর ৫০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখলেও সেটি প্রায় অব্যবহৃত থেকে যায়। প্রতিবছর কুড়িগ্রামে জাতীয় চর উৎসবের আয়োজন করে চরগুলোকে বিভিন্ন উৎপাদিত শস্য / পন্যের উপর ব্রান্ডিংয়ের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি উদ্দ্যোগতাদের চরে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলতে হবে।
৪. কুড়িগ্রামে স্থল বন্দর ও নৌবন্দর কেন্দ্রিক শিল্প কলকারখানা স্থাপনের লক্ষে প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো ও চর গুলোর উন্নয়নে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম সৌরপ্যানেল স্থাপনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
৫. কুড়িগ্রামে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে এমন স্থান নির্বাচন করা যেখানে চরের মানুষ সহজে কাজের সুযোগ পেতে পারে। তাছাড়া কুড়িগ্রাম জেলায় উন্নয়নের দিক থেকে পিছিয়ে থাকা উপজেলাকেও অগ্রাধিকার দেয়া যাতে সমগ্র জেলায় উন্নয়নের সমবন্ঠন করা যায়।
৬. কুড়িগ্রামের রৌমারীকে সরকার কতৃক একাত্তরে মুক্ত অঞ্চল ঘোষণা করার পাশাপাশি, যেহেতু এ এলাকাটিতে পাকবাহিনী ১৯৭১ সালে তাদের বিষাক্ত থাবা ফেলতে পারেনি, ২০০১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের ভূখন্ডে প্রথম অাঘাতে (বড়াই বাড়ির যুদ্ধে) এ এলাকার মানুষ দখলদার ভারতীয় বাহিনীকে পরাজয়ের মাধ্যমে বীরত্বের পরিচয় দিয়ে এলাকাটিকে কলঙ্কিত করতে দেননি তাই, এলাকাটিকে একাত্তরের মুক্ত অঞ্চল ও বাংলাদেশের পবিত্র ভূমি ঘোষণা করার ব্যবস্থা করা।
৭. কুড়িগ্রাম তথা বৃহত্তর রংপুরের মানুষের বিনোদনের একটি অন্যতম আকর্ষণ হলো নদী। কুড়িগ্রামে নদী কেন্দিক পর্যটন কেন্দ্র বিকাশের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
৮. কুড়িগ্রামের নদী গুলো ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে এর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি অবৈধ বালু উত্তলন বন্ধকরে চর গুলোর স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করার পাশাপাশি মূল্যবান বাঘাড় মাছের অভয়াশ্রম ঘোষণা করার ব্যবস্থা করা যেতেপারে।
বাংলাদেশের একটি সীমান্তবর্তী জেলা হিসেবে কুড়িগ্রাম তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যে বেশ সমৃদ্ধ হলেও দারিদ্রতা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা, শিল্পাঞ্চলের অভাবে এখানে হাজারো ফেলানীর সৃষ্টি হয়েছে। বাসন্তী-ফেলানী-মফিজ এখন এদের কলঙ্কতিলক। সরকারের ভিশন – ২০২১ বাস্তবায়নে কুড়িগ্রামের উন্নয়ন এখন তাই সময়ের দাবিতে পরিনত হয়েছে।
মোঃ রিফাজুল হক কানন
সাংগঠনিক সম্পাদক গণকমিটি,
ঢাকা মহানগর শাখা
(প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। উলিপুর ডট কমের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য উলিপুর ডট কম কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।)