আব্দুর রহীম বাবু (যমুনা ঝেল্লাআম, দুর্গাপুর, উলিপুর):
যমুনা ঝেল্লাআম একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। কুড়িগ্রাম শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার উত্তরের এই ঐতিহাসিক স্থানটি উলিপুর উপজেলার দূর্গাপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। গ্রামটির নাম দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত হলেও প্রতিটিই দুটি আলাদা ঘটনার সাথে সম্পর্কিত। গ্রামটির পাশ দিয়ে অতীতে আনুমানিক হাজার বছর আগে যমুনা নদী প্রবাহিত হয়েছিল বলে যমুনা মৌজার অন্তর্ভুক্ত হলেও ঝেল্লাআম শব্দটি এসেছে উক্ত গ্রামেরই মাঠের পাশে বিদ্যমান বিশাল একটি আম গাছকে কেন্দ্র করে, যে গাছে ধরতো অস্বাভাবিক আকারের বড় বড় আম যাকে এলাকার মানুষ ঝেল ঝেলা (যা অনেক বড় হয়ে ঝুলে থাকতো) বলে সম্বোধন করতো। তাই গ্রামের নামটি হয় ঝেল্লা-আম। কথিত আছে যে সেই গাছে চড়ে কুড়িগ্রাম শহর দেখা যেত এবং সেই গাছে বিভিন্ন ধরনের প্রাণিও বাস করতো।
ঝেল্লা আম গাছের গুড়িতে অবস্থিত মাঠটিতে অতীত আমল থেকে জারি সারি সমৃদ্ধ মহরমের এক বিশাল মেলা হতো বলে অনেকে গ্রামের এই স্থানটিকে “মেলার তল” বলে ডাকতো। মাঠটিতে মূলতঃ পাকিস্থান আমলে আনসার প্রশিক্ষন কেন্দ্র গড়ে উঠলেও এটি বর্তমানে গ্রামের একমাত্র স্কুল যমুনা ঝেল্লাআম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ। মাঠটির চারদিকে চারটি রাস্তার প্রতিটির অর্ধ কিলোমিটার পর্যন্ত এই গ্রামটি বিস্তৃত। স্কুল মাঠের পাশেই একটি ছোট জনবহুল বাজার ও মসজিদ রয়েছে। গ্রামটিতে আগে হিন্দু থাকলেও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সকল হিন্দু ভারতে চলে যায় এবং দেশ স্বাধীনের পর পুনরায় এসে সমস্ত সম্পদ বিক্রি করে চলে যায়। ফলে তাদের বসতিতে স্থান পায় মুসলমানরা। এখনো গ্রামের কিছু কিছু স্থান আছে তাদের নামে বেশ পরিচিত। যেমন কালির পাট, হিন্দুর ভিটা, ধ্বনির বাড়ি ইত্যাদি।
উচু যায়গায় অবস্থিত এই গ্রামটি বন্যায় প্লাবিত হয় না বলে দু-মৌসুমে ভালো ফসল হয়। আগে কৃষকদের গলা থেকে একসঙ্গে ভেসে আসতো জারি, সারি ও ভাটিয়ালি গান এবং রাতের কর্ম কোলাহল শেষে লণ্ঠনের আলোতে চলতো কবি গানের আসর। কিন্তু বর্তমানে আধুনিকতার ছোয়া লেগে যেন সকল ঐতিহ্য বিলীন। যেমন, আগে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হতো বিশাল আয়োজনের ফুটবল ও হাডুডু খেলা। কিন্তু তা বর্তমানে বিলুপ্ত হয়ে নতুন এসেছে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার বিশেষ আকর্ষন ক্রিকেট, ব্যাডমিনটন ও দাবা। আগে মেয়েরা গোল্লাছুট ও বউচি খেললেও গত দশ বছরে অবলম্বন হয়েছে লুডু, দাবা, ও ব্যাডমিন্টন।
৮৫০ জনের এই গ্রামটির ৮০% লোক স্বাক্ষরজ্ঞান হলেও শিক্ষিত লোক ২৫%। এ গ্রামের মানুষেরা খুবই সহজ সরল ও বন্ধুত্বপুর্ণ। আগের দিনে গ্রামের লোকেরা গ্রামে কাজকর্ম করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করলেও বর্তমান তারা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে অবস্থান করে উপার্জনের জন্য।
গ্রামের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা জনাব মাদার বকস মুমূর্ষ অবস্থায় থাকলেও গ্রামের লোকদের পরম শ্রদ্ধেয়। সব মিলে এই গ্রাম একটি সুন্দর জীবনযাপনের স্থান এবং মনোরম শান্ত পরিবেশে এর অবস্থান।
লিখেছেনঃ যমুনা ঝেল্লাআম থেকে আব্দুর রহীম বাবু
আংশিক সম্পাদনা করেছেনঃ প্রকৌ. রূপম রাজ্জাক – সম্পাদক, উলিপুর ডট কম