জরীফ উদ্দীন,
বাবা-মায়ের বয়স বাড়ানোর সাথে সাথে ছেলে-মেয়ে, নাতী-নাতনীদের নিয়ে একটা আস্ত ক্রিকেট টিম হলেও তারা শেষ বয়সে হয়ে যান একা। অথচ সব সময় চারদিকে মানুষ গীজগীজ করছে, যতœ নিচ্ছে, খেয়াল রাখছে, রুটিন মতো কথা বলতেছে তবুও তারা বড় একলা। কারো কারো স্থান হয় বৃদ্ধাশ্রমে। যে বাবা অনেক কষ্ট করে নিজে খেয়ে না খেয়ে ছেলে মেয়েদের খাওয়ান, নিজে নতুন পোষাক না পরেও ছেলে-মেয়েদের পরান। শত অভাব অনটনে থেকেও ছেলে-মেয়েদের বুঝতে দেন না অভাব কি। একদিন সেই ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে তাদের ফেলে দেয়, তিন বেলা খাওয়াতে চান না এমন কি দূরদূর করে তাড়িয়ে দেন কিংবা পাঠিয়ে দেন বৃদ্ধাশ্রমে। অথবা অনেক বড় ভাই-বোনরা বাবা মায়ের অবর্তমানে ছোটদের প্রতিষ্ঠিত করান নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নষ্ট করে। শেষ বয়সে তাদেরও একই অবস্থা। থাকতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে। এমনি এক বৃদ্ধাশ্রম থেকে পালিয়ে আসা আমিতুল মোর্শেদা বেবী এবং নাম চরিত্র ‘বাবা আমার, একলা বাবা’ আব্দুল মজিদ বাদলের এর নানা ঘটনা নিয়ে উপন্যাসটি। একজন ভাই-বোন থাকতে বৃদ্ধাশ্রমে। আর অন্য জনের ছেলে অস্টেলিয়ায়, মেয়ে নিউইয়র্ক এ থেকে খোঁজ নেওয়ার পরও একলা থাকা নিয়ে হতাশায় আত্মহত্যা করার মতো সিধান্ত নেওয়ার পক্ষে তার সব সময়ের ছায়ার মতো থাকা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক ছেলে সাদ্দামের ফেইসবুক দক্ষতা এবং অহেতুক মজার যুক্তিকথার মধ্য দিয়ে শুরু উপন্যাসটির গল্প। গল্প পড়তে মনে হবে লেখক যেন একেক সময় একেক চরিত্রের ভিতরে প্রবেশ করেছেন। কিংবা পাঠক নিজেই প্রবেশ করেছেন। যা পড়লেই বোধগম্য হবে। লেখক এই গল্পে যেন তুলে এনেছেন মানুষের ভোলা না ভোলার অনেক হিসাব। বিশেষ করে ৪০ বছর পর আঃ মজিদের বাসাতে বেবীর আগমন। স্মৃতির ফাঁকগলে সিনেমার দৃশ্যের মতো চোখে ভাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো তারপর বাদলকে ছেড়ে অন্য একটা ছেলের সাথে বিয়ে। তারপর বিচ্ছেদ। বাবার মৃত্যুর পর দায়িত্ববোধে মা ও ভাই-বোনদের মাথায় ছাতা হয়ে তাদের প্রতিষ্ঠিত করানো। আসলে পড়তে পড়তে মনে হবে যেন আমাদের চেনা কোন দৃশ্য। এইসব আমাদের নিয়ে যায় স্মৃতি হাতরিয়ে হারানো প্রিয় মানুষটির কাছে, কোন সুন্দর মুহুর্তের সময় গুলোকে। যা কখনো ভোলা যায় না।
গল্পের ধারাবাহিকতায় লেখক আমাদের চোখে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন এদেশের অসাধু প্রকাশকদের। যারা লেখক ঠকিয়ে ব্যবসা করে থাকেন লেখকের টাকায়। যার কবলে পড়েন আঃ মজিদ নিজেই। তখন রসিক পাঠকের মনে হতেই পারে স্বয়ং লেখকই আঃ মজিদ। এক্ষেত্রে বলতে হয় লেখকের সাহস আছে।
আঃ মজিদ যখন আত্মহত্যার জন্য সুযোগ খুচ্ছিলেন এমন সময় বেবীর আগমনে ফিরে পান হারানো অতীত। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রঙ্গিন দিনগুলো। আবারো জীবন হয়ে উঠে চাঞ্চল্যকর। আত্মহত্যা প্রজেক্ট এখানেই সমাপ্ত। তারপর স্মৃতিময় স্থান ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে হাসি-আনন্দে দিন ভালই যাচ্ছিল। ঠিক তখনই জেলখানার চিঠির মতো মেয়ে তাহমিনার চিঠি আর বেবীর পিছনে দাড়িয়ে লুকিয়ে পড়া তারপর রঙ্গিন সময়ের সাহিত্যচর্চার সম্মাননার নামে সাহিত্য সংগঠনের অ্যাওয়ার্ড ব্যবসার মুখোমুখি। সেই অনুষ্ঠান টিভিতে প্রচারের জন্য টাকা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি যেন আমাদের সমাজেরই বাস্তবচিত্র হয়ে ফুটে ওঠে। এক বৃদ্ধ লেখকের ক্ষুব্ধ কথায়, “বল আর কত নিবা বাবারা”।
তারপর বেবির আবারো ফিরে যাওয়া বৃদ্ধাশ্রমে। অপরপক্ষে আঃ মজিদের অসুস্থতা। মেয়ের দেশে ফিরে নিউইয়র্কে নিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা। আর এদেশের ভয়াবহ অবস্থার চিত্র মনকে বিষিয়ে দেয়। অসুস্থ থেকে সুস্থ হয়ে আঃ মজিদ গ্রামে ফেরানোর মধ্য দিয়ে গল্গ নতুন ভাবে প্রবাহিত হয়ে যেন নিয়ে যায় কুড়িগ্রামের ধরণীবাড়ী মাঝবিল নামক স্থানের মধ্যদিয়ে মধুপুর গ্রামে।
গ্রামের মানুষের একদিকে ভালবাসা অন্য দিকে কুটবুদ্ধিজীবিদের স্বার্থন্বেষী কার্যকলাপ আর রাতভর মাঝবিল বাজারের অদূরের গ্রাম খানিতে মানুষের জীবনাচরন, আঃ মজিদ সাহেবের স্মৃতিময় জীবন নিয়ে এগিয়ে চলে গল্প।
শহর থেকে কেউ গ্রামে আসলে বিশেষ করে যারা চাকুরিজীবী তাদের কাছে জমা হতে থাকে গ্রামের সভা-সমিতি, মসজিদ-মন্দির কমিটির কর্তাবাবুরা থেকে শুরু করে কন্যাগ্রস্থ পিতা, বিভিন্ন ক্রিয়া টুর্নামেন্টের কমিটি সাহায্যের আবেদন। যা লেখক খুব সুনিপুন ভাবে অঙ্কন করেছেন।
গল্প চলার পেক্ষিতে গ্রামের টাউট ব্যক্তিদের পাল্লায় পরে নিজের সম্মান রক্ষার্থে শহরে আবারো ফিরে যাওয়ার সময় মাঝবিল ব্রিজে দাড়িয়ে যখন আঃ মজিদ বাচ্চাদের বলেন, “ভয় পাবে না। আমি আবার আসব।” অন্তরে সাহস জোগায়। ঢাকায় ফিরে ইচ্ছে করে হউক আর বেবীর টানেই হউক মজিদ সাহেব চলে যান গাজিপুর বৃদ্ধাশ্রমে। আর উপন্যাসটিতে যোগ হতে থাকে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন আর বৃদ্ধাশ্রমের গল্প। যারা কষ্টের সমাপ্তি ঘটাতে চলে আসেন কিংবা পাঠানো হয় এই বৃদ্ধাশ্রমে। সেই গল্পগুলো চোখে পানি এনে দেয়। বৃদ্ধদের স্বভাবসুলভ অভিমান যেন গল্পের প্রধানতম উপজিব্য হয়ে উঠে। স্বজনদের বিমুকতা যেন নিরবে কষ্টগুলোকে উৎলিয়ে আমাদের চোখে এনে দেয় পানি আর শিহরন। আর অলক্ষ্যে বেড়িয়ে আসে আমার এবং আর কারো যেন বাবা-মাকে আসতে না হয় এখানে।
এরই মাঝে আঃ মজিদ সাহেবের ছেলে তাহমিদের দেশে ফেরা আর বাবাকে নিয়ে অস্টেলিয়ায় পাড়ি জমানোর আকুতি। অনুমতি হীন বাড়ি বিক্রির সিধান্ত মনে যেন ক্ষত সৃষ্টি করে। অবশেষে গল্প বাংলাদেশে ইতি টেনে নিয়ে যাওয়া হয় অস্টেলিয়া। লেখক ঝোপবুঝে কোপ মারার মতো সুচতুর ভাবে বর্ণনা করেন বাংলাদেশের সাথে অস্টেলিয়ার অমিলগুলো কিংবা বাংলাদেশের চরে সাথে অস্টেলিয়ার সাদৃশ্য। সে দেশের সরকারের গুণগান।
অস্টেলিয়ায় বাংলাদেশ প্রবাসীদের নিজ দেশের মানুষ পেলে যেন সয়ং চাঁদের সাক্ষাৎ পায় যা সত্যিই ভগ্নমনকে একটু সময় হলেও ভুলে দেয় দুঃখ। হঠাৎ করে লেখক সাহসীকতায় সহিত এক তরুণীর গালে থাপ্পর আর সেই তরুণীকে চাকরী দাতা বৃদ্ধের মুখে থুথু দিয়ে সবাইকে হতবাক করে দেয়। এমনকি পাঠককেও। এ ঘটনার পর আঃ মজিদ সাহেব চলে আসেন নিউইয়র্ক তার মেয়ের বাসায়। নিউইয়র্ক গিয়ে হয়ে যান আরও মর্মাহত। নাতী সৈকতকে পুলিশের আটক করানো এবং মেয়ে তাহমিনার প্রতিজ্ঞা ছেলে ছাড়া পেলে বাংলাদেশ ফেরবে বাঙালী হবে। কথাটায় ফুটে উঠে যেন প্রত্যেক প্রবাসীর দেশপ্রেম।
একদিন নিউইয়র্ক ছেড়ে আঃ মজিদ দেশে ফিরে যেন স্বস্থির নিঃশ্বাস নেন। দেশে তিনি ফিরতেই গ্রামের তরুণদের আহ্বানে আবারো গ্রামে ফিরে আসা একটা বড় পাঠাগার, আইটি প্রশিক্ষন কেন্দ্র, কালচারাল সেন্টার এবং বিনোদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে। যা গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হলে দেখতে আসবে পুরো দেশবাসী। এখানে ফুটে উঠে স্বয়ং লেখকের স্বপ্ন যা বোদ্ধা পাঠক পড়লেই বুঝতে পারবেন। বিশেষ করে যারা লেখককে চিনেন, জানেন।
আঃ মজিদ গ্রামে ফিরে কাজ শুরু করতেই এক বৃষ্টিঘন সন্ধায় বেবীর হঠাৎ করে আবারো আগমন, রাতে ইখতিয়ারের গুলিতে বেবীর মৃত্যু আর গ্রামের বর্ষাকালের দৃশ্য, কদম প্রেম, কিংবা লেখকের নিজ স্বপ্ন পুরণের মতো করে সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিনোদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, গ্রামের পাল্টিয়ে যাওয়া দৃশ্যপট, আর স্বপ্ন দেখা যে যেখানে থাকুক একদিন মিশবেই গ্রামের পূর্বপুরুষদের ধুলাবালীতে। এমনি এক চমৎকার গল্প নিয়ে রচিত “বাবা আমার, একলা বাবা” উপন্যাসটি। বোদ্ধা পাঠককে মানতেই হবে এটি একটি অসাধারণ উপন্যাস। পড়তে পড়তে মনে হবে নিজেই চোখে যেন কোন সত্য ঘটনা। সবাইকে বইটি পড়ার আমন্ত্রণ।