ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এদেশে শতকরা ৭৫ ভাগ লোক গ্রামে বাস করে। বাংলাদেশের গ্রাম এলাকায় ৫৯.৮৪% লোকের এবং শহর এলাকায় ১০.৮১% লোকের কৃষিখামার রয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান ১৯.১% এবং কৃষিখাতের মাধ্যমে ৪৮.১% মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে মূল্যবন সম্পদ উর্বর মাটি ও মিঠাপানি ।পৃথিবীর কম দেশে এত উর্বর মাটি ও মিঠাপানি আছে ।এই উর্বর মাটির উপর ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ।গ্রামাঞ্চলে কৃষিজমির উর্বর মাটির পরিমান কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে ইটভাটা গড়ে উঠা । এটা অনস্বীকার্য যে, অন্যতম নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে ইটের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু পরিবেশগত দূষণমাত্রা, অবক্ষয়, শস্যের ফলনহানী এবং সর্বোপরি জনস্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় ইটভাটার দূষণকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণে জরুরিভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।গত ২৪ ডিসেম্বর যুগান্তরের উত্তরের জনপদ পাতায় প্রকাশিত হয় “অবৈধ ইটভাটার ছড়াছড়ি ” লেখাটা পড়ে চিন্তিত হয়ে উঠি। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, ব্যক্তি মালিকানাধীন মূল্যবান গাছের বাগান এবং আবাদি জমিতে যত্রতত্র গড়ে ওঠা এসব অবৈধ ভাটার কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে কুড়িগ্রাম জেলা। চলছে ইট তৈরির মৌসুম। ইটভাটাগুলোতে অবাধে পোড়ানো হচ্ছে জ্বালানি কাঠ। এতে উজাড় হচ্ছে গাছপালা। অধিকাংশ ইটভাটায় পরিবেশগত ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স ছাড়াই চলছে ইট পোড়ানো কার্যক্রম। বেশির ভাগ ইটাভাটাই নিয়ম বহির্ভূতভাবে স্থাপন করা হয়েছে বা হচ্ছে লোকালয় তথা মানুষের বসতবাড়ি, গ্রাম-গঞ্জ, কৃষি জমিতে, নদীর তীরে । ইটভাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে আবাদি জমির উপরিভাগ, নদীর তীর এবং পাহাড়ের মাটি। কাঠ ও অত্যন্ত নিম্নমানের কয়লা পোড়ানো এবং স্বল্প উচ্চতার ড্রাম চিমনি ব্যবহার করায় ইটভাটাগুলোতে নির্গত হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে কালো ধোঁয়া। এতে ভাটার পার্শ্ববর্তী এলাকা, শহরাঞ্চল ও গ্রামীণ জনপথে পরিবেশগত বিপর্যয়সহ জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক হুমকির আশংকা সৃষ্টি হয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে ইটভাটা সৃষ্ট দূষণে বয়স্ক ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া কালো ধোঁয়ার কারণে মানুষের ফুসফুসের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট ও ঠান্ডজনিত নানা রোগ দেখা দিতে পারে।আধুনিক প্রযুক্তির পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে ১২০ ফুট উচ্চতার স্থায়ী চিমনি বা সম্পূর্ণ অবৈধ ড্রাম চিমনিবিশিষ্ট ইটভাটা। ফলে পরিবেশগত বিপর্যয়সহ জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। অবৈধ ইটভাটা বন্ধে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সাধারন সম্পাদক আবদুস সোবহান বলেন, “ইট তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে ফসলি জমির উর্বর ও সারযুক্ত টপসয়েল বা উপরিভাগের মাটি। এতে জমির উর্বরতা শক্তি ও ফসল উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে জমির উপরিভাগের মাটি কেটে ফেলা হলে আগামী ২০ বছরেও সেই জমির প্রয়োজনীয় জৈব পদার্থের ঘাটতি পূরণ হবে না। ফসলি জমির মাটির উপরি অংশ কাটা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে জমির ফলন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকাংশে কমে যাবে। এতে হুমকির মুখে পড়বে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা। যত্রতত্র গড়ে ওঠা এসব অবৈধ ইটভাটার আগ্রাসনে বিনষ্ট হচ্ছে তিন ফসলি জমি। যা কৃষি নির্ভর দেশের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। ইটভাটায় অবাধে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। ঘটছে পরিবেশ বিপর্যয়, কমে যাচ্ছে বনাঞ্চল ও ফসলি জমি। জমির উর্বরা শক্তি বিনাশের পাশাপাশি ইটভাটাসৃষ্ট দূষণ পরিবেশ বিপর্যয়সহ কৃষি উৎপাদন ও ফল-মূলের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত এবং গাছপালার স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করছে। নদীর তীরর মাটি ইটভাটায় বিক্রি করা হচ্ছে। এতে নদী ভাঙন তরান্বিত হয়। নদী ভাঙন কবলিত এলাকায় প্রতি বছর শত শত হেক্টর জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে”।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নের স্বার্থে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ২০ নভেম্বর ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩’ জারী করা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর -এর ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই তারিখের গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আইনটি ২০১৪ সালের ০১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হয়েছে। এই আইনের আওতায় জ্বালানি সাশ্রয়ী, উন্নত প্রযুক্তি সম্পন্ন জিগজ্যাগ কিল্ন্, ভারটিক্যাল স্যাফ্ট ব্রিক কিল্ন্ , হাইব্রিড হফম্যান কিল্ন্, টানেল কিল্ন্ বা অনুরুপ কোন ভাটা স্থাপন/পরিচালনা করা যাবে। আইন কার্যকর হওয়ার পর কোন ব্যক্তি আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যিক এলাকা; সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর; সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য, বাগান বা জলাভ’মি; কৃষি জমি; প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা; ডিগ্রেডেড এয়ার শেড এলাকার সীমানার অভ্যন্তরে কোন ইটভাটা স্থাপন করতে পারবেন না; নিষিদ্ধ এলাকার সীমানার অভ্যন্তরে ইটভাটা স্থাপনের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর, বা জেলা প্রশাসক কোন আইনের অধীন কোনরূপ অনুমতি বা ছাড়পত্র বা লাইসেন্স প্রদান করতে পারবে না; আইন কার্যকর হওয়ার পূর্বে, ছাড়পত্র গ্রহণকারী কোন ব্যক্তি যদি নিষিদ্ধ এলাকার সীমানার মধ্যে বা নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে বা স্থানে ইটভাটা স্থাপন করে থাকেন, তা হলে তিনি, আইন কার্যকর হওয়ার ২ (দুই) বৎসর সময়সীমার মধ্যে, উক্ত ইটভাটা, যথাস্থানে স্থানান্তর করবেন, অন্যথায় লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক অফিস থেকে জানা যায়, কাগজে-কলমে পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদিত এবং জেলা প্রশাসকের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ভাটা মাত্র ২৬টি। নতুন আবেদনকৃত ১৭টি ইটভাটা লাইসেন্স না পেলেও ইট পোড়ানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এদের একটিরও পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। অনেক ভাটায় এখনও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর চিমনী ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে বেসরকারি হিসাবে জেলায় ভাটার সংখ্যা ৬০টি, যার অধিকাংশই অবৈধ।
আইন সবার জন্যই সমান বলে জানি ।অপরাধী যেই হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় আনা জরুরী ।আশা করি প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করা থেকে বের হয়ে আসবে । লাইসেন্স পাওয়ার আগে ইটভাটা চালু পুরোপুরি আইনের লংঘনকারীদের চিহ্নিতকরে সেগুলোকে অনতিবিলম্বে বন্ধ করবে এবং সংশ্লিষ্ঠদের আইনের আওতায়য় এনে শাস্তি প্রদান করা । বিদ্যমান ১২০ ফুট উচ্চতার স্থায়ী চিমনিবিশিষ্ট যেসকল ইটভাটা এখনো উন্নত প্রযুক্তিতে রুপান্তর করা হয়নি সেগুলো বন্ধ করে দেয়া বা অনূন্য ১০(দশ) লক্ষ টাকা পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ আদায় সাপেক্ষে আগামী ৩০ জুন ২০১৭ পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা যেতে পারে ।
।রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি ,কুড়িগ্রামের প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ হাসান নলেজ বলেন, বাংলাদেশের মাটি অনেক উর্বর এবং ঢালু এলাকার দেশ ।এই উর্বর মাটি ইট তৈরি করে নষ্ট করা হচ্ছে ।আশে পাশের উচু দেশ থেকে ইট আমদানি করা যেতে পারে কিন্তু উল্টো আমাদের দেশ থেকে ইট রপ্তানি করছি। অবৈধ ইটভাটা গড়ে উঠে সম্পর্কে তিনি বলেন , আমাদের দেশের কোন ইটভাটাই আইন মেনে ইট তৈরি করছে না। আবাদি জমিতে,নদীর পাড়ে ,রাস্তার পাশে গড়ে উটা ইটভাটা গুলো অবৈধ এজন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা জরুরী ।
দেশে গাছ লাগনো আজ একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমরা তার কাঙ্খিত সুফল পাচ্ছি না। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ইটভাটায় নির্বিচারে কাঠ পোড়ানো। আধুনিক, পরিবেশ বান্ধব ও জ্বালানী সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার, নির্ধারিত মাত্রার সালফারযুক্ত কয়লা ব্যবহার, জ্বালানী হিসাবে কাঠ ও কৃষি জমির উর্বর মাটি ব্যবহার থেকে বিরত থাকা এবং সংশ্লিষ্ট আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ-এর মাধ্যমে ইটভাটা সৃষ্ট দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এলক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বন অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, মেজিস্ট্রেসী, এনবিআর এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কার্যকর ভ’মিকা পালন করতে হবে। ইটভাটা সংশ্লিষ্ট আইন বাস্তবায়নে ভাটার মালিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।
আঃ ছোবাহান জুয়েল
সহ-সমন্বয়ক, রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, কুড়িগ্রাম।