সাখাওয়াত হোসেন স্বপন:
ঘুরে বেড়ানোর সখ আমার ছোটবেলা থেকেই। বাংলাদেশের প্রায় ৪৯ টি জেলা ভ্রমণ করেছি, ভ্রমণ করেছি মহাপ্রাচীরের দেশ চীন পর্যন্ত। কিন্ত নিজের জেলা কুড়িগ্রামের সব উপজেলা যদি নাই দেখা হয় তবে তো ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কিন্ত কারণ ছাড়া সব সময় সুযোগও মেলে না। যাই হোক “রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি” এর উলিপুর থানার পাঁচপীর ইউনিয়নের কমিটি ঘোষণা উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমি এই সংগঠনের ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দাওয়াত পেলাম। সুবর্ণ সুযোগ পেলাম উলিপুর ও চিলমারী এলাকা ঘুরে দেখার। বের হলাম উলিপুর আর চিলমারি ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যে।
আপনারা হয়তো জেনে থাকবেন যে, কুড়িগ্রাম-কে সোনালী কুড়িগ্রাম বলা হয় কারণ এখানে সোনার মতো ফসল ফলে। এই এলাকার বেশিরভাগ মানুষ কৃষি নির্ভর। অপরূপ সৌন্দর্য এই কুড়িগ্রামের এবং নদী বিধৌত উলিপুর ও চিলমারির সৌন্দর্য দেখে তো আমি এই এলাকার প্রেমেই পড়ে গেছি। এই এলাকায় তুলনামূলক কম খরচেই ব্যাটারি চালিত অটো রিক্সাতে ঘুরে বেড়ানো যায়, উপভোগ করা যায় গরু-মহিষ দিয়ে হালচাষের দৃশ্য। শাক-শব্জি ও ধানক্ষেতে কৃষকের উজার করা ভালবাসা দিয়ে নিজের সন্তানতুল্য গাছপালার যত্ন নেয়ার দৃশ্যও আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্ত মনে পড়েছিল তাদের পরিশ্রমের মূল্যের কথা। তারা কি তাদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের সঠিক মুল্য পায়? হয়তো না, কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত নয়, তাদের ফসল সংরক্ষণের তেমন উন্নত ব্যবস্থাও নেই তাই মধ্যস্থ ব্যবসায়ীদের পকেটে যায় তাদের মুনাফার বড় অংশ।
যাই হোক, খুব ইচ্ছা হল এই এলাকার ঐতিহ্যবাহী স্থান পরিদর্শন করব এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার খাবো। কিন্ত কার কাছে কি তথ্য নেবো, কোথায় যাবো তা ভাবতেই মনে পড়ে গেল ulipur.com এর কথা। মোবাইলে নেট সংযোগ দিয়েই ulipur.com – এ সার্চ করে কিছু দর্শনীয় ও ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং খাবারের নাম পেলাম। প্রথমেই চলে গেলাম উলিপুরের ঐতিহ্যবাহী মুন্সী বাড়ি। অসাধারণ কারুকাজে নির্মিত প্রাচীন এ স্থাপনা এখন পরিত্যাক্ত এবং ২-১ টি কক্ষ তহসিল অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই স্থাপনা দেখে মনে হল কয়েক শত বছর আগে কোন সম্ভ্রান্ত পরিবারের শিল্পমনা কারো ধ্যানধারণার ফল এটি। অতি নিপুন কারুকাজ, ছাদ থেকে পানি নির্গত হবার জন্য যে নল দেয়া হয়েছে তার মাথায় সিংহের মুখাকৃতি দেখেই বোঝা যায় বাকি বিষয়বস্তু কেমন হবে। তবে ভালো ভাবে সংরক্ষণ না করলে হয়তো আমাদের পরের প্রজন্ম এর সাক্ষাতই পাবে না।
মরিয়ম চক্ষু হাসপাতালের নাম শুনেছিলাম ছোট বেলাতেই কিন্ত দেখার ভাগ্য হয়ে ওঠে নি। তাই উলিপুর যখন এসেছি এ যাত্রায় চক্ষু হাসপাতালটিও দেখে যাই। বিভিন্ন এলাকার গরীব, দুঃস্থ ও সাধারণ মানুষের চোখের বিভিন্ন অপারেশন ও চিকিৎসা সেবা নাম মাত্র মুল্যে দিয়ে থাকে এই মানব সেবী হাসপাতালটি।
আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম উলিপুরের বিখ্যাত মিষ্টান্ন খিরমানের কথা। “রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি’র” সহ-সমন্বয়ক আঃ ছোবাহান জুয়েলের বাসায় তার মায়ের হাতের পরম আতিথিয়তায় পড়েছিলাম। সে কী মজার আর বাহারি রান্না, নানান পিঠাপুলির আয়োজন, সত্যিই আমি মুগ্ধ। তার উপর উলিপুরের বিখ্যাত মিষ্টান্ন খিরমান খাওয়া। এর আগে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরণের মিষ্টান্ন খেয়েছি সেরা মিষ্টান্নের মধ্যে খিরমান অন্যতম হবে বলে আমার বিশ্বাস।
ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাকাও গাড়ি তুই চিলামারি বন্দরে রে…… গান টি নিশ্চয় শুনেছেন। হ্যা সেই চিলামরি বন্দরের পাশেই আমাদের প্রিয়মুখ “রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি’র” প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ হসান নলেজ ভাইয়ের বাসা। নলেজ ভাইয়ের কিছুদিন আগে এক দুর্ঘটনা ঘটে, যাতে তাঁর পায়ে বড় ধরনের এক অস্ত্র পাচার করে তিন মাসের বিছানা বিশ্রাম দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। তাঁকে দেখতে চলে গেলাম তাঁর বাসায়। নলেজ ভাইয়ের ছেলে সংঘ, সে আর এক জ্ঞানী মানুষ। আমাকে দেখেই বলে ফেলল- “তুমি সাক্ষাৎ স্বপন”? আমি বললাম না বাবা “ আমি সাখাওয়াত স্বপন”। তাঁর বাবার ফেসবুক থেকে আমার প্রোফাইল দেখেছিল। যাই হোক সেখানেও আতিথিয়তার কমতি নেই। পেট পুজো করে চলে গেলাম একসময়ের সেই বিখ্যাত আন্তর্জাতিক নদীবন্দর যা চিলামারি বন্দর নামে পরিচিত। অনেক সুন্দর একটা জায়গা, হয়তো একসময় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠবে এখানে। তবে সৈয়দ শামসুল হকের কুড়িগ্রাম ৪২০ টি চর এবং প্রায় ২০ টি নদী দিয়ে প্রকৃতি সমৃদ্ধ করে দিলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব বেশি উন্নত না হওয়ায় অন্যান্য জেলা থেকে পিছিয়ে রয়েছে। তাই কুড়িগ্রামের মানুষের প্রাণের দাবিতে রূপ নিয়েছে “ঢাকা-কুড়িগ্রাম আন্তঃনগর ট্রেন চাই”।
ভালো থাকুক কুড়িগ্রাম, ভালো থাকুক বাংলাদেশ।
লেখক, সাধারণ সম্পাদক, রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, ঢাকা মহানগর শাখা।
shakhawat.swapon@yahoo.com