মোঃ আব্দুল কাইয়ুম রনজু:
কুড়িগ্রাম পুরাতন রেলস্টেশন। ঐতিহ্যকে গলা টিপে মেরে ফেলার সংস্কৃতি থেকে রেহাই না পাওয়া এক দুর্ভাগা নাম। মফস্বল শহর কুড়িগ্রামে তখন পুরাতন স্টেশন এবং নূতন স্টেশন নামে দুটো রেলওয়ে স্টেশন।ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া সভ্যতায় রেলগাড়িই ছিল সেসময় দূরপাল্লার একমাত্র আধুনিক পরিবহন। কুড়িগ্রাম পুরাতন শহরে আমাদের বাড়ির পাশেই রেললাইন। কৈশোরে খোলা জানালায় দুরন্ত দু’চোখ পেতে রেলগাড়ির পু-ঝিকঝিক ছুটে চলা দেখতাম আর রং তুলিতে আঁকা ছবির ক্যানভাসে নিজেকে হারাতাম।
রেললাইনের এপার ওপারের সুখদুঃখের বাসিন্দা হয়ে দিনগুলো ভালই কাটছিল। স্কুল বন্ধের সময়ে রেললাইনকে ভাগ করে পাড়ার বন্ধুরা মিলে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা জমতো। লাইনের সরু পাতে অবিরাম হেঁটে চলার বাজি হতো। রেল গেইটের লোহার চার থাম্বা দখলের প্রতিযোগিতা চলতো। রেল সিগন্যালের আপ-ডাউনকে নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়া হতো। গেইটম্যান চাচার শত বাঁধাকে উপেক্ষা করে রেললাইনকে ঘিরেই আমাদের ছোটবেলার ডানপিটে যত ছুটাছুটি চলতো।রেল লাইনে কান পেতে আমরা দূরে থাকা ট্রেনের শব্দ শুনতে পেতাম। রেলগেইটের দুইধারে সারিসারি টগর ফুটে থাকতো। আমরা সেই ফুলে মালা গেঁথে বাড়ি ফিরতাম।মাঝে মাঝে মনে হতো সমান্তারাল এই রেললাইনের মাঝ ধরে হাঁটতে হাঁটতে দুনিয়াটা ঘুরে বেড়ালে কেমন হয়?
তখন দুপুর ১২.৩০টায় পুরাতন স্টেশনে রমনা মেইল আসতো। তিন স্টেশন পর আমার নানার বাড়ি। আমার মা’র সেই নানাবাড়ি যাওয়ার দিনগুলোয় আমি রেললাইনের পাশে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতাম। মা ট্রেনের জানালা দিয়ে রুমালে বাদাম বেঁধে আমার দিকে ছুঁড়ে মারতো আর আমি মনের উৎফুল্লে বাদামের পোটলা কুড়াতে ব্যস্ত হতাম। অনেক রাতে রংপুর থেকে একটা ট্রেন আসতো। আমরা ভাই-বোনেরা সেই ট্রেন আসা অবধি রাত জেগে জোরে জোরে শব্দে পড়তাম।
আমাদের ভাইবোনদের স্বপনের দূরত্বটাই ছিল ট্রেনে চড়ে নানার বাড়ি যাওয়ার পথ। বাড়ির পাশ দিয়ে রমনা মেইলের আসা দেখেই আমরা রিক্সাযোগে পুরাতন ষ্টেশনে পৌঁছাতাম।তারপর ট্রেনের কামরায় বসে দু’পাশের চলন্ত দৃশ্যে চোখ জুড়াতাম।টগরাই হাট স্টেশনের পাশের পুকুরে ফুটন্ত লাল পদ্মে ছেয়ে যাওয়া বা রাজার হাটের দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠে মাঠে উড়ন্ত বাতাসের ঢেউ এ মন ছুঁতে থাকায় আমরা সিঙ্গের ডাবরি হাটে এসে নামতাম।প্রতি বছর চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে অষ্টমীর স্নানে চিলমারী এবং সিন্ধুর মতি মেলাকে ঘিরে ট্রেনের ছাদে উপচে পড়া মানুষের ভিড়ের সঙ্গে গগন ফাটা আনন্দ চিৎকার শোনা যেত।আমরা রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে এই নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করতাম আর হাত নেড়ে এই বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসের জবাব দিতাম।
একসময় বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের উন্মোচিত দুয়ারের হাওয়া কুড়িগ্রামে এসেও লাগলো।বিস্তৃত সড়ক পথে বাস চলাচলের যাত্রা শুরু হল।পক্ষান্তরে কুড়িগ্রামের রেল যোগাযোগের পরিণতিতে দিন দিন অবনমন, উপেক্ষা, অবহেলা নামক শব্দগুলো জেঁকে বসলো। একদিন ঢাকায় বসে দুঃসংবাদ এলো কুড়িগ্রাম পুরাতন শহর থেকে রেল যোগাযোগ উপড়ে ফেলা হয়েছে। আমার স্বপ্নের স্মৃতিতে শকুনের এমন আঁচড়ে মনটা বিষিয়ে উঠলো।
কেন এমন হল?গোটা পৃথিবী জুড়ে নিরাপদ যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে দুর্বার গতিতে রেলগাড়ি যখন ছুটছে ঠিক তখনই এমন দুর্বল একপেশে হটকারি সিদ্ধান্ত আমাকে অবাক করলো।মাথা ব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলা। এরকম এক নাজুক অজুহাতে এমনটি হয়েছে বলে মনে হলো।কিভাবে ট্রেনের গতি বাড়ানো যায়, কিভাবে কুড়িগ্রাম পুরাতন স্টেশন থেকে ধরলার ওপারে অথবা সীমানা পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে রেল যোগাযোগের প্রসারতা বৃদ্ধি করা যায়,সে কথা একবারও ভাবা হল না।তড়িঘড়ি করে এক ধ্বংসের আখ্যান রচনা করা হলো।
আজ কুড়িগ্রাম-ঢাকা আন্তঃনগর ট্রেনের দাবিতে আন্দোলন চলছে। এই যৌক্তিক আন্দোলনের পতাকায় যারা অবস্থান করছে তাঁরা জানে সৃষ্টি লড়াইয়ের পিছনটা কত অমসৃণ সে তুলনায় ধ্বংস কত মসৃণ!তারপরও হয়তো একদিন ঢাকা থেকে কুড়িগ্রাম এবং কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকা আন্তঃনগর ট্রেন ছুটবে।সে ছুটার দাবীতে নেতৃত্ব দেওয়া মানুষেরা কুড়িগ্রামের জনগণের হৃদয়ে ইতিহাস হয়ে থাকবে অথচ আমার সেই স্বপ্নের স্মৃতিতে গেঁথে থাকা আমাদের বাড়ির পাশের রেলগেইটে সারি সারি সাদা টগরগুলো ফুটতে আর কখনও দেখা যাবে না।
লেখক, মোঃ আব্দুল কাইয়ুম রনজু , সরকারি কর্মকর্তা, ঢাকা।