।। নুরনবী মিয়া ।।
আমার জন্মটাই ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামে। কিছু বুঝতে শেখার পর থেকেই দেখছি বিভিন্ন প্রকার মাদকদ্রব্য। চোখের সামনেই বসেছিল মাদকের হাট। দেখেছি অনেক ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়। এখন নজরে না এলেও অগোচরে সেসব থেমে নেই। বর্তমান সমাজে মাদকাসক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে অনেক ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। মাদকের ভয়াল থাবায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তরুণ যুবসমাজ। দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে মাদকাসক্তের তালিকা। এ তালিকায় স্থান দখলের প্রতিযোগিতা করছে স্কুল-কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। এসব কথা কারও অজানা থাকার কথা নয়। মাদক প্রতিরোধে বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি সংস্থা ও সুধী সমাজ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেটাও আমরা দেখেছি। দেশের আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার লোকজন মাদকের ছোট-বড় চালান ও চোরাচালানকারীদের গ্রেফতার করে আইনের কাছে সোপর্দ করছে। তবুও কিন্তু মাদকের চোরাচালান থামছে না। দেশের অভ্যন্তরে যদি চাহিদা থাকে, তাহলে আমদানি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। এজন্য প্রয়োজন মাদক সেবনকারীদের নেশায় আসক্তি থেকে ফিরিয়ে আনা। সেবনকারীর সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারলে মাদকের চোরাচালানও অনেকাংশে কমে যাবে। এতে অর্থ পাচার থেকে মুক্তি পাবে দেশ।
মাদক প্রতিরোধ করার জন্য অনেক সভা-সেমিনার অনুষ্ঠিত হতে দেখেছি। সভা-সেমিনারে অনেক উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ পদবির ব্যক্তিবর্গসহ গুণীজনদের উপস্থিতি লক্ষ্য করেছি। আমি নিজেও উপস্থিত থেকে অনেক কথা শুনেছি। বিভিন্ন জায়গায় মাদক প্রতিরোধে অনেক স্লোগান দেখেছি। তবে সেসব ছিল অন্যান্য সভা-সেমিনারের থেকে একেবারেই আলাদা। আমি ভুট্টা চাষীদের সেমিনারে গিয়ে দেখেছি সেখানে অনেক ভুট্টা চাষী ছিলেন। পাট চাষীদের কর্মশালায় গিয়ে দেখেছি সেখানে প্রায় সবাই পাট চাষী। সাংবাদিকতা বিষয়ক কর্মশালায় গিয়ে দেখেছি সবাই সাংবাদিক। কিন্তু মাদক প্রতিরোধের সভা-সেমিনারে যাওয়ার আগেই শুনি প্রোগ্রামে কিছু ভালো ছেলে লাগবে। সেখানে গেলে দেখা যায় সমাজের সুধীজন, বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ব্যক্তিবর্গ। সেখানে কোনো মাদকাসক্ত লোকের চিহ্ন পর্যন্ত থাকে না। মাদকাসক্তরা এরকম প্রোগ্রামের নাম শুনলেই, তিন’শ গজ দূর দিয়ে পাশ কেটে চলে যায়। এমনকি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদকের বিরুদ্ধে আলোচনা হলে সেখানেও মাদকাসক্ত শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি থাকে না। খোঁজ খবর নিলে জানতে পারবেন মাদকের কুফল সম্পর্কে তারা তেমন একটা অবগত নয়।
দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ ও গভীর বিশ্লেষণে আমি বেশ কিছু বিষয় উপলব্ধি করেছি। মাদকের করাল গ্রাস থেকে শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনতে কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রথমত আমাদেরকে জানতে হবে, শিক্ষার্থীর হাতে মাদকটা আসছে কীভাবে? কারা সরবরাহ করছেন, কারা কারা যুক্ত আছেন, বিষদ ঘটনা উপলব্ধি করার পর ঐ শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং করতে হবে। নিশ্চিত সে নেশার দিকে ধাবিত না হয়ে সুস্থ জীবনে ফিরে আসবে। কোনো মাদকাসক্ত ব্যক্তি যখন মাদকের কুফল সম্পর্কে সবকিছু জানতে ও বুঝতে পারে, তখন সে ঠিকই সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে চেষ্টা করে এবং সুস্থ জীবনে ফিরে আসে। তবে তাদেরকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে গেলে আরও অনেক গতিপথ জানতে হবে। অন্যান্য শ্রেণি-পেশার লোকজনের চেয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দিকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া দরকার। মাদক প্রতিরোধে শিক্ষার্থীরাই অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।
পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের হাতে যারা মাদক সরবরাহ করছেন এবং যাদের সঙ্গে সেবন করছেন তাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী নন। তবে কেন তারা শিক্ষার্থীদের হাতে মাদক তুলে দেন, এবং প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেছে যে, তারা মাদক সেবনের অর্থ যোগাতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপর নির্ভর করে। শিক্ষার্থীদের আরও বেশি আকর্ষিত করতে সহজ শর্তে নানান রোমান্টিক কুপ্রস্তাব আদান-প্রদানসহ বিভিন্ন নোংরামির আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশে রাস্তার মোড়ে অপেক্ষার প্রহর গুনে। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বুঝতেই পারেনা যে এই বখাটে মাদক সেবীরা তাদের সাথে বন্ধুত্বের ছলনা করে টিফিনের টাকায় ভাগ বসাচ্ছে। এজন্য যেসব শিক্ষার্থী মাদক সেবন করে তাদেরকে খুঁজে বের করে বন্ধুসুলভ আচরণের মাধ্যমে সবকিছু জেনে নিতে হবে। তারপর সবকিছু জেনে বাস্তবতার আলোকে তাদের কাউন্সিলিং করতে হবে। তাদেরকে সঠিকভাবে বোঝানো সক্ষম হলে তারা মাদক সেবন থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করবে এবং সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে। সেইসাথে শিক্ষার্থীদের হাতে মাদক তুলে দেয়া বখাটেদেরকে চিহ্নিত করে আইনের কাছে সোপর্দ ও সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার।
এখানে অনেক সাজ নেয়া সুধীজন বাধা হয়ে সামনে আসার চেষ্টা করবে। তারা বিভিন্ন যুক্তি নিয়ে আসবে মাদক ছড়াছড়ির পক্ষে সাফাই গাইতে। কারণ এতে তাদের ব্যবসায় ধস নেমে আসার শঙ্কা করেন তারা। সমাজের অনেক মুখোশধারী পতি আছেন, অরাজকতা না হলে তাদের রুজি রোজগার হয় না। সমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার মাধ্যমে অনেকের মুখে আহার জোটে। তাদেরও মুখোশ উন্মোচন করে জনসম্মুখে নিয়ে আসতে হবে।
আমি মনে করি, আগামীর প্রজন্মকে মাদকমুক্ত একটি সুন্দর সমাজ উপহার দিতে সমাজের দায়িত্বশীল ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঠিক পদক্ষেপই যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে। তবে আমাদেরকে সঠিক পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে ভালো করে জানতে হবে। বিশেষ কিছু কৌশল অবলম্বন করেই মাদক প্রতিরোধ করা সম্ভব।
লেখক:
নুরনবী মিয়া
ফুলবাড়ী, কুড়িগ্রাম।