আলপনা আক্তার আদৃতা:
আমাদের এই সৃজনশীল সমাজে শ্রেণিবৈষম্য একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে যুগ যুগ ধরে আচ্ছে সেই সামন্তবাদ থেকে শুরু করে আজ অবধি। সমাজে কিছু শ্রেণির মানুষ কখনোই পায়নি তাদের বাঁচার নায্য অধিকার। আমাদের সমাজের এমনি এক অবহেলিত তথা নিচু জাতি হিসেবে পরিচিত হরিজন তথা মেথর জাতি, যারা দিন রাত এক করে সমাজের নোংরা-আবর্জনা অপসারিত করে, অপবিত্র কে পবিত্র করতে সদা নিবেদিত, তাদেরকে আমাদের সমাজ মূল্যায়ন করতে এখনো দ্বিধায় ভুগছে। নিজের সমাজে তাদের পাচ্ছে না মেনে নিতে। সমাজে থেকেও তারা যেন দলছুট কোন প্রাণী বিশেষ। তাদের দৈনন্দিন জীবন, চাওয়া-পাওয়া, আচার-আচরণ, সভ্য মানুষের অবহেলা এককথায় মূল্যবান ভাবধার সমাজের কথিত নিচু মেথর জাতির উপর রচিত “মেথর সমাচার” বইটি। বইটি রচনা করেছে লেখক হায়দার বসুনিয়া। এটিই প্রথম রচনা আমাদের সমাজের আখ্যায়িত নিচু ও ঘৃণিত মেথর জাতি কে নিয়ে, যারা সমাজকে পবিত্র করে।যাদের থাকার কথা সমাজের অন্যান্য জাতিদের সম্মান নিয়ে, হয়ত তাদের থেকে আরও উপরে, কিন্তু তাদের অবস্থান সমাজের নিকৃষ্টতম স্থানে। তারা পায়না তাদের সঠিক মূল্যায়ন। অথচ তাদের অবদান বর্ণনাতীত, যা সকলের উপলব্ধি করার ক্ষমতা থাকলেও কারও সময় আর ইচ্ছা শক্তি নেই তাদেরকে নিয়ে একটু ভাবার। অথচ সেই তারাই আমাদের জন্যে সুন্দর, সুশোভিত, স্বচ্ছ বায়ু ও নির্মল পরিবেশ, সুস্থ জীবন উপহার দিয়ে যাচ্ছে নিজেরা কলুর বলদের মত খেটে। আমারা ভুলেই যাই সেই বিখ্যাত উক্তি “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই”। অথচ সেই নিচু মেথর জাতি তা কখনই ভুলে যায়না, ঠিক এমন ভাবধারায় বইটি রচিত, মেথররাও চেষ্টা করে, চায় উন্নত জীবন ধারায় প্রবাহিত হইতে। ওরা সম্মান নিয়ে বাঁচতে চায় বাকি সবার মত যা বইটিতে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন; মেথর জাতিরা তাদের ক্লান্তি দূর করতে যদি সামান্য এক কাপ চা পেতে চায় তবুও তাদেরকে নিজেদের গ্লাস বা কাপ সাথে করে বহন করতে হয়, অন্যথায় তাদের কপালে ক্লান্তিলগ্নে কোনো চা নসিবে মেলেনা। জাতির কাছে প্রশ্ন, কেন এই শ্রেণী বিভেদ? এই কি আমরা সৃজনশীল জাতি?যেখানে মানুষ হিসেবে আমারা মানুষ কে মূল্যায়ন করতে শিখিনি, কিভাবে আমরা নিজেদের আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে দাবি করি? অপর দিকে বইটিতে বিশেষভাবে উল্লেখিত একটি ঘটনা রয়েছে, ঘটনাটি এমন যে, কোনো এক পর্যায়ে মেথর সমাচার রচনাটির একটি মূল চরিত্র “দোয়ারিয়া” এক জন অন্ত:সত্তা উন্মাদিনী কে তার ঘরে ঠাঁই দেয়, অথচ মেথর দোয়ারিয়া এবং তার পরিবার ও জাতি জানেনা যে সেই উন্মাদিনী জাতি হিসেবে মুসলিম নাকি হিন্দু, নাকি খ্রিষ্টান? মেথররা যদি কে কোন জাতি এইটা ভুলে গিয়ে আমাদের নির্মল বায়ু, সুস্থ জীবন,আর পবিত্রতা রক্ষার্থে, সবার সেবায় নিজেদের কে সর্বদা নিয়োজিত রাখতে পারে তবে কেন আমাদের তাদের প্রতি এত বিরুপ মনভাব? কেন তাদেরকে এত অবহেলিত আর অপমানিত হতে হয়? কেন আমরা তাদের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারিনা? একটি বার কি আমারা ভেবে দেখেছি যে তাদের অনুপস্থিতি আমাদের কি পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে?অথচ ওরাও পারে আমাদের মত লেখাপড়া শিখে উন্নত জীবন গড়তে যা রচনাটির মূল চরিত্র দোয়ারিয়া তার ছেলেকে দিয়ে প্রমাণ করতে পেরেছে। আসলে আমরাই পারিনা নিজেদের কে সৃষ্টির সেরা হিসেবে প্রমাণ করতে, পারিনা আমাদের উন্নত মনভাব প্রকাশ করতে? জাতির কাছে প্রশ্ন আমরাকি তবে কর্তব্য পালনে অক্ষম নাকি ভীত? এত সংকীর্ণ মনভাব নিয়ে কি আমারা উন্নত জাতি হিসেবে নিজেদের তথা দেশ ও জাতির কল্যানে নিবেদন করতে পারব? একটি বার আমরা কি বিবেকের কাঠগড়ায় নিজেদের কে দাঁড় করাতে পারিনা?নাকি আমরা ভয় পাই?তাহলে কিসের আমরা শ্রেষ্ঠ জীব? কিসের মনুষ্যত্ব? কিসের মানুষ আমরা? যদি সঠিক ভাবে ঠিক ভুলের বিচার না করতে পারি,যার যা প্রাপ্য তা না দিতে পারি! হ্যা বইটি ঠিক এমনি ভাবধারায় রচিত। একটি অসাধারন ভাবধারার বাহক এই বইটি। সব শেষে আমি অসংখ্য শ্রদ্ধা এবং ধন্যবাদ নিবেদন করছি বইটির লেখক শ্রদ্ধেয় হায়দার বসুনিয়াকে।
তার দীর্ঘায়ু কামনা করছি, আর কামনা করছি তিনি যেন আমাদের এভাবেই সমাজের বাকি
অবহেলিত জাতিকে তুলে ধরে, যাতে একটু হইলেও আমাদের বিবেক নাড়া দেয়, এবং সেই জাতিরা যেন তাদের অধিকার আদায়ে তদুপরি নামে মাত্র আমাদের সুশীল সমাজ তাদের প্রাপ্যটা দিতে একটু সচেতন হয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, বি.বি.এ, ৩য় বর্ষ, বেগম রোকেয়া ইউনিভার্সিটি