।। উপজেলা প্রতিনিধি ।।
যে স্থানে সব ধরণের মাছের জন্য নিরাপদ আশ্রয়, মুক্তভাবে বিচরণ ও অবাধ প্রজনন ঘটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঠিক সেখানেই উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদ মৎস্য অভয়াশ্রমে অভিনব পদ্ধতিতে তৈরি করা চায়না দুয়ারী জাল বা ডারকি জালের ফাঁদ পেতে শুরু হয়েছে ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নিধনের মহোৎসব। অবৈধ এই জাল দিয়ে এক শ্রেণির অসাধু জেলে মা মাছ নিধন করলেও মৎস্য বিভাগসহ স্থানীয় প্রশাসনের নেই কোনো নজরদারি।
অসাধু মৎস্য ব্যবসায়ীরা নদীতে অবাধে অবৈধ জাল দিয়ে মাছ ধরায় চলতি বছরে দেশীয় মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে এই অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মৎস্য সম্পদ বিলুপ্তির আশঙ্কা করছে অনেকেই।
চায়না দুয়ারী জাল বা ডারকি জাল সম্পর্কে এই এলাকায় জনশ্রুতি আছে, চীন দেশের লোকজন তাদের ক্ষেত খামারে বিভিন্ন প্রজাতির পোকামাকড় নিধনের জন্য এ জাল তৈরি করে। এক থেকে দেড় ফুট প্রস্থ, ৪০ থেকে ৫০ ফুট দৈর্ঘের ক্ষুদ্র ফাঁসবিশিষ্ট এই জাল। লোহা রিং দিয়ে ঢোলক আকৃতি ও মাঝে মাঝে চতুর্ভুজ আকারের লোহা দিয়ে তৈরি এই বিশেষ ফাঁদ। একটি করে জালে ৪০-৫০ টি করে খোপ আছে। বিশেষ কৌশলে এই জালের দুই মাথা খুটির সাথে বেঁধে ফাঁদ পেতে রাখে খাল-বিল, নদী-নালা ও জলাশয়ের তলদেশ দিয়ে। জালের কাঠামোতে লোহা থাকায় জালটি পানির তলদেশে পৌঁছায়। এই জাল ক্ষুদ্র ফাঁসের কারণে সেই পথ ধরে ছোট থেকে বড় যে কোন ধরণের জলজ প্রাণী চলাচল করলে অনায়াসে জালের ভিতরে প্রবেশ করবে। এই জালের ফাঁদে যে কোন মাছ প্রবেশ করলে আর বের হতে পারে না। এ জালে আটকা পড়ে ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এমন ছোট পোনাও আটকা পড়ে যা কোন কাজে লাগে না বলে সেগুলো ফেলে দেন মাছ শিকারিরা। চায়না দুয়ারী জাল দিয়ে কিছু অসাদু ব্যক্তি ডিমওয়ালা মা ও পোনা মাছ অবাধে নিধন করছে। অবৈধ এই জালের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় মাছের স্বাভাবিক প্রজনন, বংশ বিস্তার ও বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। এর প্রভাবে নদ-নদীতে মাছের প্রাচুর্য কমে যাচ্ছে। অচিরেই এসব জাল বন্ধ না হলে দেশের মৎস্য ভাণ্ডারে বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা স্থানীয়দের।
সরেজমিনে হাতিয়া ও সাহেবের আলগা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ব্রহ্মপুত্র নদের মাঝে ডিঙি নৌকা দিয়ে চায়না দুয়ারী জাল বা ডারকি জালের ফাঁদ পেতে জেলেরা মাছ শিকার করছেন। একটি সূত্র জানিয়েছে, ওইসব এলাকায় প্রতিটি মাছ ধরা নৌকার জেলের কাছে ২৫-৩০ টি করে এই জাল রয়েছে।
স্থানীয় সুমন দাস নামের জেলে জানান, মাছ শিকার আমাদের প্রধান পেশা। আমরা বাপ-দাদার হাত ধরে মাছ ব্যবসায় এসেছি। এলাকায় আমাদের মাঝি বলে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সারাদিন নদী থেকে যা মাছ পাই তা বাজারে বিক্রি করে সংসার চলাই। এখন আর ডারকি জালের জন্য মাছ পাওয়া যায় না।
আরেক জেলে মনোরঞ্জন দাস জানান, সরকার চায়না দুয়ারী জাল নিষিদ্ধ করছে কিনা জানি না। এই জাল দিয়ে সব ধরণের মাছ ধরা পড়ে। এখন যারা কখনো মাছ ব্যবসায় আসেনি তারাই এখন ডারকি জাল নদীতে ফেলে রাখে। আর ওইসব জায়গায় আমরা জাল ফেলতে পারি না। এ নিয়ে বিভিন্ন জনের সাথে মাঝেমধ্যে ঝগড়া-ঝাটিও হয়। অপেশাদার অনেকে চায়না দুয়ারী জাল নদীতে ফেলে রাখে, আগের মত মাছও পাই না আয়ও হয় না। শুধু সুমন দাস আর মনোরঞ্জন নয় হাতিয়া ইউনিয়নের মাঝি পাড়া গ্রামের প্রায় দুই শতাধিক মৎস্যজীবী চরম দুর্দিনে পড়েছেন।
সরকার পাড়া গ্রামের বাসিন্দা শহিদুল মুন্সি বলেন, মাছের চরম শত্রু হলো চায়না দুয়ারী বা ডারকি জাল। এই জালে পোনাসহ সব ধরণের মাছ ধরা পড়ে। অবৈধ জাল দিয়ে দিনে রাতে মাছ ধরলেও প্রশাসন খোঁজ রাখে না। শুধু সরকার ইলিশ ধরা বন্ধ ঘোষণা দিলে তখন একটু আসে এছাড়াও বছরের অন্য সময় তাদের দেখা পাওয়া যায় না। সরকার যদি এসব জাল দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ না করে তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই এলাকায় দেশীয় মাছের দেখা পাওয়া যাবে না।
এদিকে সাহেবের আলগা ইউনিয়নের মাছ ব্যবসায়ী আছর উদ্দিন বলেন, আমি দুই যুগের বেশি সময় ধরে মাছের ব্যবসা করি। এ বছরের মতো মাছ সংকটে আমি পড়ি নাই। তিনি আরও বলেন, নদীতে অবৈধ জাল দিয়ে মাছ ধরায় পোনাসহ ডিমওয়ালা মাছ কমে যাওয়ার এমন সংকট দেখা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে হাতিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রধান শিক্ষক বিএম আবুল হোসেন বলেন, চায়না দুয়ারী জাল, স্থানীয় কারেন্ট ও ফাঁসি জাল এগুলো দিয়ে অবাধে মাছ শিকার করছেন জেলে পেশা ছাড়াও অজেলেরা। ফলে দিনে দিনে বহুজাতের মাছ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যদি এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ না নেয়, তবে আগামী প্রজন্ম মাছ কাগজ-কলমে দেখবে বাস্তবে নয়।
এ বিষয়ে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার তারিফুর রহমান সরকার বলেন, মৎস্যকূল রক্ষায় নদ-নদীতে শুধু চায়না দুয়ারী জাল নয় সকল প্রকার অবৈধ জাল দিয়ে মাছ ধরার অভিযান অব্যাহত আছে।
//নিউজ//উলিপুর//মালেক/নভেম্বর/০৪/২৩