জরীফ উদ্দীন:
ভাইরে আগের দিন আর নাই, রিক্সাওয়ালা তুলিয়া দিছে মোর গাড়ীয়ালী কামাই’ কিংবা ‘হায়রে ঝগড়ি ভাবি তোর কিসের এত দাবী, কোন দুঃখে মুঁই কামাই করিম কয়টা মোর খাওয়াইয়া’ অথবা ‘কান্দেরে ঢাল কাউয়া দেখি পাকা তাল, খালুও না পালুও না রে, কাউয়া তোর কম্বক্তা কপাল’ তাছাড়াও ও মুঁই পাগলা হনুরে, তোমরা কেমন কেমন আছেন ফুল মিয়া, ও তোমরা কোন দিন আসিবেন, মজা শিদলে ভর্তা করি। এই জনপ্রিয় গানগুলোর সাধারন মানুষের মুখে মুখে শুনলে যে লোকটির মুখচ্ছবি রূপালী পর্দায় মতো চোখে ভেসে উঠে। তিনি ভূপতি ভূষণ বর্মা। ভাওয়াইয়া গান যখন বাংলাদেশে বিলুপ্তির পথে নিজ স্খান ছেড়ে অবহেলা অনাদরের ফলে আত্মাভিমানে হাড়িয়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখনি যে কয়জন মহান ব্যক্তি ভাওয়াইয়া প্রেমী হাল ধরেছেন তার মধ্যে অন্যতম ভূপতি ভূষণ বর্মা। তিনি আজ শুধু এই ভাওয়াইয়া অঞ্চল নামে খ্যাত রংপুরে সীমাবদ্ধ থাকেননি। সমগ্র দেশ ছাড়াও বর্তমানে বাংলাদেশের অভিভাবক হিসাবে গান পরিবেশন করতে এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতার বিচারক হিসাবে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য সরকারের আমন্ত্রণে বছরে বেশ কয়েকবার ভারতে পারি জমান তিনি। আসছে ২০ নভেম্বর মাসে তিনি সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের একটি লোকসংগীত সাংস্কৃতিক দলের সাথে মধ্য প্রাচ্যের আরব আমিরাতে যাওয়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। সেখানে তিনি ভাওয়াইয়া গান পরিবেশন করবেন।
এই মহান গুনি শিল্পী একাধারে ভাওয়াইয়া গানের পৃষ্ঠপোষক ও সংগঠক। তিনি ভাওয়াইয়া গান কে উজ্জবিত করতে নিজ প্রচেষ্টায় কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার দুর্গাপুরে স্থানীয় মহৎ ব্যক্তিদের সহযোগীতায় ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন করেন বাংলাদেশ ভাওয়াইয়া একাডেমি। বর্তমানে তিনি একাডেমির পরিচালক হিসাবে আছেন প্রতিষ্ঠা কাল থেকেই। এই একাডেমির সূচনালগ্ন থেকে শিক্ষার্থী ২১০০ ছাড়িয়েছে এবং এদের মধ্যে বিভিন্ন শিক্ষার্থী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে দেশে প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের তালিকায়। তিনি গ্রামীণ ঐতিহ্যকে লালন করতে প্রতিষ্ঠা করেন কছিম উদ্দিন লোকশিল্প সংগ্রহশালা। যাতে স্থান পেয়েছে পাঁচশ এরবেশি গ্রাম-বাংলার লোকজ তৈজসপত্র।
তিনি ভাওয়াইয়া গানের প্রচার, গবেষনা এবং ভাওয়াইয়া গানে অবদানকারীর জীবনী ও ভাওয়াইয়ায় অবদান আঞ্চলিক ভাষা রক্ষা, ইতিহাস- ঐতিহ্য বিভিন্ন দরবারে তুলে ধরতে প্রকাশ করেছেন ত্রিমাসিক ভাওয়াইয়ালোক বর্তমান দুই বাংলার পাঠক মহলে বেশ সমাধিত।
এই মহান ব্যক্তি ভূপতি ভূষণ বর্মা স্বপ্ন দেখেন গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাওয়াইয়া গানের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে তা বই আকারে প্রকাশ করে সংরক্ষিত করা ও ভাওয়াইয়াকে বিশ্ব শিল্প-সাহিত্যাঙ্গণে র্দীঘায়ু করা এবং লোকসংগীতের বই গানের সিডি ক্যাসেট এর সংগ্রহশালা তৈরি। এছাড়াও লোকসংগীত শিল্পীদের ছবি সংগ্রহ করে গ্যালারী তৈরি এবং প্রয়াত শিল্পীদের সমাধী পাকা করণের দৃঢ় ইচ্ছা তার। তিনি চান ভাওয়াইয়ায় সংশ্লিষ্ঠ ব্যক্তি ছাড়াও সংগীত ও সমাজে অবদানকারীদের সম্মাননা পদক প্রদান করে উৎসাহিত করতে।
মহৎ এই গুনি শিল্পী ভাওয়াইয়ার বিস্ময় ভূপতি ভূষণ বর্মা কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের আঠারো পাইকা গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ২৮ অক্টোবর ১৯৫৭ সালে (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ) জন্মগ্রহণ করেন। বাবা নরেন্দ্রনাথ বর্মা ছিলেন স্কুল শিক্ষক এবং মাতা কার্মাক্ষাময়ী দেবী গৃহিণী ছিলেন।
মন্ডলের হাট উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণিতে থাকাকালীন বার্ষিক প্রতিযোগিতায় আব্বাস উদ্দীনের গান ও মোর কালারে কালা ওপারে ছকিলাম বাড়ি কলা রইলাম কালা সারিসারি গেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করায় গানের প্রতি ঝুকে পরেন। এখান থেকেই শিল্পী হওয়ার বাসনা জাগে। দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পরিবারের সাথে ভারতে চলে যান। যুদ্ধ শেষে ভারত থেকে ফিরে এসে ৮ম শ্রেণিতে ভর্তি হন দুর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। এসময় তিনি গ্রামের লোকজনদের নিয়ে গড়ে তোলেন রামলীলা কির্তন। এই সময় হাতেখড়ি হিসাবে রামলীলা কির্তনের তালিম নেন সুরেন্দ্রনাথ রায়ের কাছ থেকে। যার প্রধান হিসাবে তিনি ছিলেন। খুব অল্প সময়ে চারদিকে তাদের দলটির সুনাম ছড়িয়ে পরে। দশম শ্রেণির পরীক্ষার আগে লেখাপড়ায় মনবিনেশ করায় দলটি ভেঙ্গে যায়। ১৯৭৫ সালে এসএসসি পাশ করেন এবং ১৯৭৮ সালে এইচএসসি পাশ করেন। এসময় পারিবারিক ভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন লালমনিরহাটের পঞ্চগামের শীবেন্দ্রনাথ নারায়নের কন্যা সাধনা রায়ের সাথে। পরিবারটি ছিল সংগীত পরিবার। সাধনা রায়ের বড় ভাই সুভাষ চন্দ্র রায় তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত বেতার লোকশিল্পী। স্ত্রীর অনুপ্রেরণায় স্ত্রীর অনুপ্রেরণায় তিনি গান শেখা শুরু করেন সুভাষ রায়ের কাছে থেকে। বিয়ে করে সংসারী গৃহস্থলীর কাজ করার সুপ্ত বাসনা থাকলেও স্ত্রী এবং শ্বশুরের অনুপ্রেরণায় তিনি বিএসসি তে ভর্তি হন কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজএ। এই সময় ভাওয়াইয়া গানের সাথে অন্তরঙ্গে ভাসিয়ে দেন নিজেকে। তালিম নেন, শিল্পী সুভাষ চন্দ্র চন্দ্র রায় ছাড়াও, কছিম উদ্দীন, অনন্ত কুমার, নুরুল ইসলাম জাহিদ, রবীন্দ্রনাথ মিশ্র ও নীল কমল মিশ্রের কাছ থেকে।
১৯৮১ সালে বিএসসি পাস করেন। ১৯৮২ সালে বকশীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে সহঃ শিক্ষক হিসাবে যোগদানের মধ্য দিয়ে পেশা হিসাবে বেচে নেন শিক্ষকতা। এরপর মাত্র ৪ মাস শিক্ষকতা করার পর মন্ডলের হাট উচ্চ বিদ্যালয়ে কিছু দিন শিক্ষকতা করেন। পরে ১৯৮৩ সালে দুর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে সহঃ শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। বর্তমানে অত্র বিদ্যালয়ের সহঃ প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৮২সালে তিনি ভাওইয়া শিল্পী হিসেবে রংপুর বেতারের তালিকাভুক্ত হন। বর্তমানে তিনি বিশেষ গ্রেডের শিল্পী হিসেবে গান পরিবেশন করেন। এছাড়াও ২০০৭ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত হন। বর্তমানে তিনি ভাওয়াইয়ার ’ক’ শ্রেণির শিল্পী। তার কন্ঠে রেকর্ডকৃত গানের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। প্রকাশিত সিডিঃ-ফেরিওয়ালা,পাপের বাপে কয়,মনে জানে মনের কথা, ঢালুয়া খোপা।
তিনি সংগীতে অবদান রাখায় পেয়েছেন ভাওয়াইয়া একাডেমি রংপুর কর্তৃক “আব্বাস উদ্দিন পদক”,পশ্চিমবঙ্গ মণীষি পঞ্চানন স্মৃতি রক্ষা কমিটি কর্তৃক সম্মাননা,প্রচ্ছদ ,কুড়িগ্রাম কর্তৃক গুণী শিল্পী সম্মাননা পদক ,রংপুর ক্ষত্রিয় সমিতির শততম বার্ষিকী সম্মাননা পদক। এছাড়াও ওস্তাদ মমতাজ আলী খান একাডেমি, বাংলাদেশ লোক সংগীত পরিষদ, সলিডারিটি কুড়িগ্রাম থেকে সম্মাননা পদক উল্লেখযোগ্য।
ব্যক্তি জীবনে তিনি দুই কন্যার সন্তান। স্ত্রী প্রয়াত হয়েছেন ২০০৭ সালে। আজও স্ত্রীর স্মৃতি বহন করে ভাওয়াইয়া গানকে লালন পালন করে যাচ্ছেন মহান এই গুণী শিল্পী। ভাওয়াইয়ার জীবন্ত কিংবদন্তি ভাওয়াইয়া ভাস্কর ভূপতি ভূষণ বর্মা।
আজ তার ঊনষাটতম জন্মদিনে উলিপুর ডট কম এর পক্ষ থেকে জানাই শুভেচ্ছা ও অভিন্দন।
লেখক, সহঃ সম্পাদক, উলিপুর ডট কম