শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। শিক্ষা মানুষকে করে তোলে ধীমান ও মহিয়ান। মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসে শিক্ষা। শিক্ষা মানুষকে জানতে ও বুঝতে শেখায়। একজন সুশিক্ষিত ও মেধাবী লোক যেমনি দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ তেমনি জাতির বিবেকও বটে – যারা আত্মশক্তিতে বলিয়ান সামনের দিকে আলোর মশাল হাতে ধেয়ে চলেন, ক্ষান্ত হন না কোন মতেই। পিছুটান তাকে হার মানাতে পারে না – হার মানাতে পারে না কোন অশুভ শক্তিই। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন – “সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত”। আর সেই মেধা সম্বলিত ও নানা গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিটি যদি একজন আদর্শবান শিক্ষক হন তাহলে তো কোন কথায়ই নেই। একজন আদর্শ শিক্ষক হলেন দেশ ও জাতির বিবেক ও মনন, যিনি নিজ হাতে অনেক মানুষ গড়ার পাশাপাশি গড়ে তোলেন অনেক আলোকিত মানুষ।
প্রজ্ঞা, জ্ঞান, বুদ্ধি, বিচার, বিবেক, ধৈর্য্য, নিষ্ঠা, সততা, অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে যিনি তাঁর শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো অকাতরে বিলিয়েছেন এবং এখনো বিলিয়ে যাচ্ছেন তেমনি একজন ব্যক্তি হলেন শ্রীযুক্ত বাবু নির্মল চন্দ্র সরকার। নির্মল বাবু হিসেবে কুড়িগ্রাম তথা উত্তরাঞ্চলে পরিচিত ও সম্মানিত। তিনি কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের পান্ডুল গ্রামে ১৯৪২ সালের ৩১ জানুয়ারী জন্ম গ্রহন করেন। বাবা কিরণ চন্দ্র সরকার ও মা হেমন্ত বালা দু’জনেই প্রয়াত। তৎকালীন বৃটিশ শাসনামলে অর্থাৎ দেশ বিভক্তির পূর্বে পিতামহ প্রয়াত বাবু কৈলাস চন্দ্র সরকার একজন মধ্যসত্ত্বভোগী জোতদার ছিলেন। বাবা মায়ের দুই সন্তানের মধ্যে বাবু নির্মল চন্দ্র সরকার অনুজ। অগ্রজ বেলা রাণী সরকার স্বপরিবারে বর্তমানে ভারতের কোচবিহার জেলায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। বাবু নির্মল চন্দ্র সরকার দুর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর কৈলাস রঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়, রংপুরে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৫৮ সালে তিনি কৃতিত্বের সাথে মেট্টিকুলেশন পাশ করেন। পরবর্তীতে কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, রংপুর থেকে ১৯৬০ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৬২ সালে বি. এ. পাশ করেন। ১৯৬২ সালে বি. এ. পাশ করার পর দুর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে চাকুরিতে যোগদান করেন।
তৎকালীন সময়ে যারা দুর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন তাঁদের মধ্যে মো. আহির উদ্দিন সরকার ( প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ), মো. আব্দুল গফুর ( সহকারী প্রধান শিক্ষক ), অনিল চন্দ্র দত্ত ( সহকারী শিক্ষক ), আহম্মেদ হোসেন (সহকারী শিক্ষক ), নূর মোহাম্মদ আলী (সহকারী শিক্ষক), মো. কমর উদ্দিন সরকার (সহকারী শিক্ষক), মাওলানা মো. শামছুল হক (সহকারী শিক্ষক), ভূবতী ভূষণ বর্মা (সহকারী শিক্ষক) প্রমুখ উল্লেখ্য। ১৯১৪ সালে দুর্গাপুর স্কুল প্রতিষ্ঠার সময়ে এটি Middle English School (M.E) হিসাবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে এটি Higher English School (H.E) তে রূপান্তরিত হয়। শ্রীযুক্ত বাবু নির্মল চন্দ্র সরকার ১৯৬৭ সালে বি. এড. সমাপ্ত করেন এবং পদোন্নতি পেয়ে প্রথমে সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং পরে ১৯৭৮ সালে প্রধান শিক্ষক পদে অধিষ্ঠিত হন।
১৯৭৪ সালে তিনি গাইবান্ধা জেলার ভরতখালী গ্রামের অজিত কুমার সিংহ ও রাধা রাণী সিংহ (দুজনেই প্রয়াত ) এর মেয়ে শ্রীমতি আরতি রাণী সরকারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ব্যক্তিগত জীবনে শ্রীযুক্ত বাবু নির্মল চন্দ্র সরকার চার সন্তানের জনক। বড় মেয়ে মালবিকা সরকার (শিল্পী), মেজো মেয়ে স্মরণিকা সরকার (লিপি), ছোট মেয়ে পারমিতা সরকার (মিষ্টি) ও একমাত্র ছেলে সাহিত্য রঞ্জন সরকার (পলাশ)। বাবু নির্মল চন্দ্র সরকার শুধু একজন আদর্শ শিক্ষকই ছিলেন না সেই সাথে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ অভিভাবকও। সততা, ভদ্রতা, নম্রতা, জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেক-বিবেচনায় তিনি একজন আদর্শ মানুষ। তিনি শুধু স্কুলেই একজন আদর্শ ও দক্ষ শিক্ষক ছিলেন তা কিন্তু নয়, পরিবার-সমাজ-সংগঠন এবং সর্বোপরি এ অঞ্চলের মানুষের কাছে আদর্শবান শিক্ষক হিসাবে অতি পরিচিত। ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁর কাছে সন্তানতুল্য। শ্রেণীকক্ষের পাঠদানের সময় তিনি যেমন হাস্যোজ্জ্বল ও সকলের প্রিয় ছিলেন তেমনি তাঁর কঠোরতায় ক্লাশে ফাঁকি দেয়ার কোন উপায় ছিল না। কালো ফ্রেমের চশমা পরিহিত লম্বা চওড়া সুদর্শন চেহারায় বাবু নির্মল চন্দ্র সরকার এখনও বুদ্ধিদীপ্ত ও গৌরবজ্জ্বল। তাঁর অনেক ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষা ও সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুনামের সহিত কর্মরত রয়েছেন। তিনি স্কুলে শুধু সহকর্মীদের কাছে প্রিয়ভাজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন না, সেই সাথে ছিলেন ভদ্র, নম্র, বিনয়ী ও আদর্শ শিক্ষক। ছাত্রছাত্রীরা ছাড়াও তিনি অন্যকে তিনি অতি সহজে আপন করতে জানেন। আত্মঅহংবোধ বলতে তাঁর মধ্যে কিছু নেই।
অনেক বড় মাপের বড় মনের একজন মানুষ তিনি। ভাল মন্দ বিচার বিবেচনায় তিনি কখনও অন্যের মতামতকে উপেক্ষা করতেন না। যে কোন বিষয়ে তিনি খুব ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত ও কাজ করার সুপরামর্শ দিতেন। কোন ভালো কাজে তাঁর বরাবরই উৎসাহ ছিল, এখনও আছে এবং মন্দ কাজের তীব্র নিন্দা ও বিরোধিতা করেন এখনও নিঃসঙ্কোচ চিত্তে। স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তাঁর এই শিক্ষাক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ও তাঁর স্কুল (দুর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয় ) ১৯৯৬-৯৭ সালে পরপর দুবার জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ও জেলার শ্রেষ্ঠ স্কুল নির্বাচিত হয়। সারা বাংলাদেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ‘প্রথম আলো’ কর্তৃক আয়োজিত ২০০২ সালে প্রথম আলো জেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন। শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত এই মহান আদর্শ শিক্ষক বেঁচে আছেন বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল তাঁর কর্মালোকে একজন আদর্শ শিক্ষক তথা আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে। তাঁর জীবন দীর্ঘ মঙ্গলময় হোক এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের।
সুত্রঃ মামুন রিপন, সুশান্ত রায় ও দুর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয় এলামনাই অ্যাসোসিয়েশন শীর্ষক ফেসবুক পেইজ
সম্পাদনাঃ ইঞ্জিনিয়ার রূপম রাজ্জাক, সম্পাদক – উলিপুর ডট কম