জরীফ উদ্দীন,
‘হামার মরন হয়, জীবনের মরন নাই’ কথাটি আসলে ধ্রুবতারার মত সত্য। সৈয়দ হক তার ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ এর শেষ দৃশ্যতে তাই জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি মরে গেলেন ঠিকই তার জীবনের মরন হয়নি। তিনি বেঁচে থাকবেন তার সাহিত্য-কর্মে, আমাদের মাঝে অনন্তকাল অবধি।
আর কেনইবা তিনি বেঁচে থাকবেন না! তার হাত ধরেই তো উঠে এসেছে এক সংগ্রামী কৃষক নেতা নূরলদীন। যে একদিন ভীত কাঁপিয়েছিল ব্রিটিশদের আর বাংলার জনগণকে দিয়েছিল সংগ্রামে যোগ দেয়ার ডাক, “জাগো বাহে কোনঠে সবাই।” যে কথাটি উত্তরের মানুষের শুধু নয় সমগ্র দেশবাসীর প্রেরণা হিসাবে আজও শক্তি জোগায়।
তিনি সৃষ্টি করেছেন অনেক কালজয়ী কাব্য। তার সেই কাব্যগুলো যেন শুধু তারই থাকেনি হয়ে উঠেছে সার্বজনীন। আমাদের মনের কথা।/”যখন সৌজন্য যায় কবরে মাটি কল্পতায়, /যখন স্তব্ধতা গিলে খেতে থাকে কামুকেরা ত্রাসে,/ তখন তাকিয়ে দেখো শুদ্ধতার গভীর ব্যাথায়_/আমার ঠোঁটের থেকে একটি যে শব্দ একদিন ফুটেছিলো/এই ঠোঁটে তোমারই যে দেহস্পর্শ তাপে,/আজ সেই শব্দ দ্যাখো পৃথিবীর বুকে অন্তরীণ_/তবু তারই উচ্চারণে বৃক্ষপাতা বারবার কাঁপে। /পড়ে নিও তুমি তাকে, দেখে নিও আকাশে নয়তো/সেই শব্দ ‘ভালোবাসি’ নক্ষত্রের মতোই হয়তো।” কিংবা যখন প্রেমিকার অনুপ্রেরণায় অকপটে স্বীকার করেন,
“রাতের অন্ধকার এখন আমার ছবি আঁকার ক্যানভাস।/তোমার চোখের আলো আমার রঙ।
একদিন তোমাকে যে ছুঁয়েছি সেই আঙুল আমার তুলি এখন।/আমি তোমার ঘুমের ছবি আঁকছি।/তুমি নিলীন হয়ে শুয়ে আছো এখন আমার ছবির ভেতরে।/এই ঘুম থেকে তোমাকে আমি জাগবো না।”
“ওকি গাড়িয়াল গাড়িয়াল ভাই” অথবা ” ও মোর মাহুত বন্ধুরে” এই বিখ্যাত ভাওয়াইয়া গানে যেমন প্রকাশ পেয়েছে নারীর আকুতি ঠিক তেমনি “পরাণের গহীন ভিতর” এ আমরা পাই,
“আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান,/ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়, / ঘরের বিছন নিয়া ক্যান অন্য ধান খ্যাত রোয়?- / অথচ বিয়ার আগে আমি তার আছিলাম ধ্যান। / আছিলাম ঘুমের ভিতরে তার য্যান জলপিপি।” আমার জানামতে এরকম আর আকুতি ভরা লেখা আর অন্য কোন বাঙ্গালি কবির কবিতায় পাওয়া যায়নি। হয়ত যাবেও না বাহের দেশের কথায়, মূর্খ কৃষক-চাষার ভাষাতে,
“মানুষ এমন ভাবে বদলায়া যায়, ক্যান যায়? / পুন্নিমার চান হয় অমাবস্যা কিভাবে আবার? / সাধের পিনিস ক্যান রঙচটা রদ্দুরে শুকায়? / সিন্দুরমতির মেলা হয় ক্যান বিরান পাথার? / মানুষ এমন তয়, একবার পাইবার পর / নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর।”
তিনি কত নিপুণভাবে দেশপ্রেম ফুটে তুলেছেন অসংখ্য কবিতায়। তুলে এনেছেন ইতিহাস-ঐতিহ্য। দেশ ছেড়ে কোথাও না যাওয়ার অভিব্যপ্তি।
“তোমার দেহে লতিয়ে ওঠা ঘন সবুজ শাড়ি। / কপালে ওই টকটকে লাল টিপ। / আমি কি আর তোমাকে ছেড়ে / কোথাও যেতে পারি? / তুমি আমার পতাকা, আমার কৃষির বদ্বীপ।”
তিনি শুধু কবিতায় নন রেখে গেছেন অসংখ্য গল্প, কথা কাব্য, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক, গীতিনাট্য, সিনেমার গল্প, গান। লিখে গেছেন দুহাতে আর পেয়েছেন সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য তাঁকে ‘সব্যসাচী লেখক’ উপাধি। সব্যসাচী লেখক হিসেবে তাঁর পরিচিতি রয়েছে।। সৈয়দ শামসুল হক মাত্র ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান। বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়া সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে এ পুরস্কার লাভ করেছেন।
তার লেখা , ‘চাঁদের সাথে দিবনা আমি তোমার তুলনা’, ‘এমন মজা হয় না গায়ে সোনার গয়না’, ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’, ‘তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তোরা দেখ দেখ দেখরে চাহিয়া’ ইত্যাদি গান সমৃদ্ধ করে বাংলা চলচ্চিত্রকে। যা আজও শ্রোতাদের হৃদয় কেড়ে নেয়। এখনো মুখেমুখে ফেরে তার রচিত গানগুলো।
মহা কিংবদন্তি সৈয়দ শামসুল হক জম্মগ্রহণ করেন ১৬ নদী বিধৌত কুড়িগ্রাম জেলায় ১৯৩৫ সালে ২৭ ডিসেম্বর। বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন, মা হালিমা বেগম। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুলে। সেখান থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে তিনি কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুল থেকে ১৯৫০ সালে গণিতে লেটার মার্কস নিয়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার বাবার ইচ্ছা ছেলেকে ডাক্তারি পড়াবেন। পিতার এই ইচ্ছা অপেক্ষা করে ১৯৫১ সালে বাসা থেকে পালিয়ে যান মম্বে। সেখান কিছুদিন কাজ করেন সিনেমা প্রোডাকশন হাউজে সহকারী হিসেবে। এসব ছেড়ে তিনি আবারো ১৯৫২ জগন্নাথ কলেজে মানবিক শাখায় ভর্তি হন। এর পর ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে অনার্স পড়া শুরু করলেও তা আর শেষ করা হয়নি। মন দেন বই প্রকাশে ১৯৫৬ সালে। তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’ প্রকাশ হলে রাতারাতি জনপ্রিয়তায় উঠে আসেন তিনি।
তারপর ফিরে তাকাতে হয়নি পিছনে অবিরাম লিখে গেছেন
প্রবন্ধঃ হৃৎ কলমের টানে (১ম খণ্ড ১৯৯১ , ২য় খণ্ড ১৯৯৫ )
ছোট গল্পঃ তাস ( ১৯৫৪ ), শীত বিকেল ( ১৯৫৯ ), রক্তগোলাপ ( ১৯৬৪ ), আনন্দের মৃত্যু ( ১৯৬৭ ), প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান ( ১৯৮২ ), সৈয়দ শামসুল হকের প্রেমের গল্প ( ১৯৯০ ), জলেশ্বরীর গল্পগুলো (১৯৯০), শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৯০)
কবিতাঃ একদা এক রাজ্যে ( ১৯৬১ ), বিরতিহীন উৎসব ( ১৯৬৯ ), বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা ( ১৯৭০ ), প্রতিধ্বনিগণ ( ১৯৭৩ ), অপর পুরুষ (১৯৭৮ ), পরাণের গহীন ভিতর (১৯৮০ ), নিজস্ব বিষয় ( ১৯৮২ ), রজ্জুপথে চলেছি ( ১৯৮৮ ), বেজান শহরের জন্য কোরাস ( ১৯৮৯ )
এক আশ্চর্য সংগমের স্মৃতি (১৯৮৯), অগ্নি ও জলের কবিতা (১৯৮৯)
কাননে কাননে তোমারই সন্ধানে (১৯৯০), আমি জন্মগ্রহণ করিনি (১৯৯০), তোরাপের ভাই (১৯৯০), শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯০), রাজনৈতিক কবিতা (১৯৯১ ), নাভিমূলে ভস্মাধার, কবিতা সংগ্রহ
প্রেমের কবিতা, ধ্বংস্তূপে কবি ও নগর (২০০৯)
উপন্যাসঃ এক মহিলার ছবি ( ১৯৫৯ ), অনুপম দিন (১৯৬২ ), সীমানা ছাড়িয়ে ( ১৯৬৪ ), নীল দংশন (১৯৮১ ), স্মৃতিমেধ ( ১৯৮৬ ), মৃগয়ায় কালক্ষেপ (১৯৮৬), স্তব্ধতার অনুবাদ ( ১৯৮৭ ), এক যুবকের ছায়াপথ (১৯৮৭), স্বপ্ন সংক্রান্ত ( ১৯৮৯ ), বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ (১ম খণ্ড১৯৮৯, ২য় খণ্ড ১৯৯০), বারো দিনের শিশু (১৯৮৯), বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল (১৯৮৯), ত্রাহি (১৯৮৯), তুমি সেই তরবারী (১৯৮৯), কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন (১৯৮৯), শ্রেষ্ঠ উপন্যাস (১৯৯০), নির্বাসিতা (১৯৯০), নিষিদ্ধ লোবান (১৯৯০), খেলা রাম খেলে যা ( ১৯৯১ ), মেঘ ও মেশিন (১৯৯১), ইহা মানুষ (১৯৯১), মহাশূন্যে পরাণ মাষ্টার, দ্বিতীয় দিনের কাহিনী, বালিকার চন্দ্রযান, আয়না বিবির পালা, কালঘর্ম, দূরত্ব, না যেয়ো না, অন্য এক আলিঙ্গন, এক মুঠো জন্মভূমি, বুকঝিম ভালোবাসা, অচেনা, আলোর জন্য, রাজার সুন্দরী
কাব্যনাট্যঃ পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৬ ), গণনায়ক ( ১৯৭৬ ), নুরুলদীনের সারা জীবন ( ১৯৮২ ), এখানে এখন (১৯৮৮ ), কাব্যনাট্য সমগ্র (১৯৯১ ), ঈর্ষা, বাংলার মাটি বাংলার জল, নারীগণ
কথা কাব্যঃ অন্তর্গত
অনুবাদঃ ম্যাকবেথ, টেম্পেস্ট, শ্রাবণ রাজা (১৯৬৯ )
শিশুসাহিত্যঃ সীমান্তের সিংহাসন (১৯৮৮), আনু বড় হয়, হড়সনের বন্দুক
সিনেমাঃ গেরিলা, ‘মাটির পাহাড়’, ‘তোমার আমার’, ‘রাজা এল শহরে’, ‘শীত বিকেল’, ‘সুতরাং’, ‘কাগজের নৌকা’ বড় ভালো লোক ছিল, অন্যান্য
লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন অগণিত পাঠকের ভালোবাসার পাশাপাশি দেশের প্রায় সব প্রধান পুরস্কারই নিজের অর্জনের খাতায় জমা করেছেন তিনি। বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৬৬, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৬৯, অলক্ত স্বর্ণপদক ১৯৮২, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৩, কবিতালাপ পুরস্কার ১৯৮৩, লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক, ১৯৮৩, একুশে পদক , ১৯৮৪, জেবুন্নেসা-মাহবুবউল্লাহ স্বর্ণপদক ১৯৮৫, পদাবলী কবিতা পুরস্কার,১৯৮৭, নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক, ১৯৯০, টেনাশিনাস পদক, ১৯৯০, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গীতিকার, মযহারুল ইসলাম কবিতা পুরস্কার ২০১১। সর্বশেষ পেলেন কুড়িগ্রামের মানুষের ভালোবাসার প্রতিদান রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির দেওয়া গণসংবর্ধনা।
ব্যক্তি জীবনে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে পারি জমালেন অন্য জগতে ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর । তার কথাই সত্যি হল
“আমি একটুখানি দাঁড়াব এবং দাঁড়িয়ে চলে যাব; / শুধু একটু থেমেই আমি আবার এগিয়ে যাব;
না, আমি থেকে যেতে আসিনি; / এ আমার গন্তব্য নয়; / আমি এই একটুখানি দাঁড়িয়েই এখান থেকে চলে যাব। / আমি চলে যাব / তোমাদের এই শহরের ভেতর দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি……।”
সেই শহর ছেড়ে সত্যিই চলে আসলেন সেই ছেড়ে যাওয়া জলেরশ্বরীর কোলে। আমাদের কুড়িগ্রামে। এই যে আসলেন আর ফিরে যাবে না সেই শহরে। রোজ শুনবেন আধকোশার আর্তনাদ। আর
“যখন গাছের তলে এই দেহ দিবে কালঘুম, / যথন ফুরায়া যাবে জীবনের নীল শাড়ি-বোনা / তখন কি তারা সব কয়া দিবে আগাম-নিগুম?”
হয়ত দিবে, নয়ত দিবে না। কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের গাছের তলেই কালঘুমে কাটাবেন সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক। ওনার পারলৌকিক জীবনের শান্তি কামনা করি।