রেজা রহমান, উলিপুরঃ
মোঃ বানছার আলী। ছোটবেলা থেকে অদম্য সাহস ছিল তাঁর। কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের যমুনা ব্যাপারী পাড়ায় জন্ম নেওয়া এই অদম্য সাহসী বানছার আলী ছিলেন নয় ভাই বোন – এর মধ্যে সর্ব জ্যৈষ্ঠ সন্তান। বাবা বৃদ্ধ হওয়ায় অতি অল্প বয়সেই বড় সংসারের হাল ধরতে হয়েছে তাঁর। ৭ই মার্চ ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিলে বানছার আলী ও তাঁর আপন ভাই সৈয়দ আলী দেশকে রক্ষার্থে নিজ আগ্রহ ও বুদ্ধিমত্তায় যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল ছিলেন। বাবা রহিম উদ্দিন ব্যাপারী ও মা সুরতভান বেওয়া ভালো করেই জানেন বড় ছেলে নাছোড়বান্দা, না গিয়ে ছাড়বে না। দরকার হলে না বলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে বের হবে যুদ্ধে যাওয়ার উদ্দেশ্যে, তবুও যাবে। বাধ্য হয়ে বাবা বড় ছেলের সাথে সেজো ছেলে সৈয়দ আলীকেও যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।
দুই ভাই এক সাথে গেলে মিলে মিশে থাকতে পারবে এই বিশ্বাসে দুই ছেলেকেই পাঠিয়ে দিয়ে বললেন দেশকে মুক্ত করেই ফিরবি তোরা। যাওয়ার আগে মায়ের কান্না ভরা চোখ-মুখ দেখে মাকে সান্ত্বনা দিয়ে আড়ালে গিয়ে দুই ভাই চোখ মুছতে মুছতে রওয়ানা দিলেন। ভারতে ওস্তাদ আবু বক্করের কাছে অল্প কিছুদিনের প্রশিক্ষণ শেষে দেশকে রক্ষায় সরাসরি ১১নম্বর সেক্টর -এর চিলমারী উপজেলার কোদালকাঠি এলাকার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগ দেন দুই ভাই। এদিকে বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ। দুই ছেলেকে যুদ্ধে পাঠানোয় স্থানীয় রাজাকাররা এসে হুমকি দিয়ে গেছে ছেলেদের ফিরিয়ে না আনলে বাড়িঘর পুড়ে দেবে। তার কয়েকদিন পরই বানছার আলী খবর পেলেন তাদের বাড়ী নাকি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ধান-চাল সব পুড়ে গেছে। কিছু আস্ত রাখেনি রাজাকার ও হানাদার বাহিনী। ইতিপূর্বে বাড়ি ছেড়ে সবাই অন্যত্র লুকিয়ে আছে। এদিকে ছোট ভাই সৈয়দের শারীরিক অবস্থা হঠাত খারাপ করেছে, কয়েকদিন ধরে শরীরে জ্বর তার উপর আবার ব্রক্ষ্মপুত্র নদী পার হওয়ার সময় রাইফেল পানিতে পড়ে গেছে।
সৈয়দকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হলে বাড়িঘর আবার কোনরকম ঠিক করা হল যাতে মাথা গোঁজা যায় আপাতত। বানছার আলীর যুদ্ধে যাওয়া নিয়ে কিছুদিন পর আবারও বাড়ি পুড়ে দেয়া হল। অন্যের কাছে ধার করা ধান-চালও এবার অবশিষ্ট থাকল না। এদিকে বানছার আলী দায়িত্বের সহিত নিজের দেশ তথা দেশমাতৃকাকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে যুদ্ধে রত। এবার ক্যাম্প করলেন চিলমারীর ঠাকুরের চর এলাকায়, যাতে হানাদার বাহিনী উলিপুর-চিলমারী দখল শেষে নদী পার হয়ে রৌমারী-রাজীবপুর দখল করতে না পারে। এই উদ্দেশ্যে ঠাকুরের চর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প করার দরকার হয়ে পড়েছে। মুক্তিযোদ্ধা বানছার আলীর ভাষায়, “একদিন আনুমানিক ২২-২৩ রোজার দিন চিলমারী ঘাট (আগে নদী বন্দর ছিল) থেকে প্রায় ৪ মাইল দুরে ঠাকুরের চর, এখানেই চরের এক কোনায় আমাদের মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প। সে সময় পুরো চিলমারী ঘাট হানাদারদের দখলে ছিল। হঠাত মুক্তিবাহিনীরা লক্ষ্য করলেন ব্রক্ষ্মপুত্র নদের কিনারায় প্রায় ১৫০-২০০ জন হানাদার বাহিনীর সদস্য আমাদের ক্যাম্প আক্রমণে এগিয়ে আসছিল। ওদের উদ্দেশ্য মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প গুড়িয়ে দিয়ে বিশাল নদীটা পার হয়ে রৌমারী-রাজীবপুরে আক্রমণ চালাবে। দুর থেকে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা নৌকায় করে এদিকে তেড়ে আসছে হানাদারের দল আর সাথে কিছু নন-ড্রেসের পাকিস্তানি দোসর তথা রাজাকার। অপর দিকে যেখানে আমাদের ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধা মাত্র ৯০-৯৫ জন । নিঃসন্দেহে গৌণশক্তি ছিলাম আমরা। তবু তো ভয় পেলে চলবে না, লড়তে হবে যতক্ষণ প্রাণ আছে আমাদের। সেই সাহসটা আমাদের আছে। অস্ত্রের বিচারেও আমরা পিছিয়ে। তবু নির্ভীক জাতির দায়িত্বশীল সৈনিক আমরা।”
ক্যাম্পের হেড কমান্ডার এনামুল হক তাড়াতাড়ি আক্রমণের জন্য বললে সেখানে বানছারের অকুতোভয়ী আচরণ দেখে মুগ্ধ হোন সবাই। যেন বানছার একাই লড়তে প্রস্তুত। ভারী শক্তির হানাদারদের সাথে লড়তে বন্দুকের নল তাক করলেন বানছার ও তাঁর দলের সবাই। রক্ত টগবগ করা অকুতোভয় মুক্তিবাহিনী মাটির গর্তে নিজেদের আড়াল করে বন্দুকের নলে চোখ রেখে শুরু করলো গোলাগুলি পর্ব। হানাদারবাহিনী দুর থেকে মুক্তিবাহিনীর প্রস্তুতি টের পাওয়ার আগেই বানছার ও তাঁর সহযোদ্ধারা আক্রমণ করলে কয়েকজন পাকসেনা গুলিবিদ্ধ হয়ে নৌকা থেকে নদীতে পড়ে যায়। পুরো দুই-আড়াই ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর তারা নৌকা ঘুরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে মুক্তিবাহিনীরা আরো এগিয়ে গেলে ওরা দ্রুত চলে যায়। এই ঘটনায় বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হলেও বীরবাঙ্গালী মুক্তি সেনাদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
বানছার আলী নিজের একার কৃতিত্বকে বড় করে নিজেকে ‘সেরা যোদ্ধা’ বলতে নারাজ। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন বীর বাঙ্গালীর যুদ্ধ করার অকুতোভয় ভাব সবার মধ্যে সমান না থাকলেও সবার প্রবল দেশপ্রেম ও নিজস্ব ধরনের মেধায় এরকম একটি যুদ্ধ জয় সম্ভব হয়েছে, তাই এই জয়ের ভাগীদার সবাই সমানভাবে। যুদ্ধকালীন সময়ের নিজের ব্যক্তিগত কোন বীরত্বপূর্ণ মুহূর্ত বা প্রশংসা করতে তিনি রাজি নন। হয়তো বয়স কিংবা সময়ের কাছে বানছারের স্মৃতি সব কিছু খেয়াল রাখতে পারেননি। কিন্তু মনে আছে যে আমরা তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে হলেও দেশকে স্বাধীন করেছি। স্যালুট জানাই বানছার আলীর মত হাজারো বীর মুক্তিযোদ্ধাকে।
[লেখকঃ রেজা রহমান, ছাত্র – আইন বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ]