।। লাইফস্টাইল ডেস্ক ।।
বন্যায় নিম্নাঞ্চলসহ বসতবাড়ির অনেক অংশই পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় পানীয় জল ও বর্জ্য পদার্থ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। মানুষ ও পশুপাখি ভয়াবহ পরিস্থিতির স্বীকার হয়। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে বন্যা ও বন্যা-পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের রোগবালাই দেখা যায়। এর মধ্যে পানি ও কীটপতঙ্গবাহিত রোগের সংখ্যাই বেশি। বন্যার সময় ময়লা-আবর্জনা, মানুষ ও পশুপাখির মলমূত্র এবং পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা একাকার হয়ে এসব উৎস থেকে জীবাণু বন্যার পানিতে মিশে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে বন্যায় সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার বেড়ে যায়।
বন্যার সময় যেসব স্বাস্থ্য সমস্যা হয়
➤ বন্যার সময় পানিবাহিত রোগগুলো বেশি হয়। কারণ, তখন পানির উৎসগুলো সংক্রমিত হয়। নলকূপ ডুবে যায়। বিশুদ্ধ পানির অভাব দেয়া দেয়। যার ফলে, আমাশয়, ডায়রিয়া, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস হয় সবচেয়ে বেশি। তাই এই রোগগুলো থেকে সতর্ক থাকতে হবে।
➤ কিছু মশাবাহিত রোগ হয়, যেমন—ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু। আটকে থাকা পানিতে এই রোগের জীবাণুগুলো সহজেই বংশবিস্তার করতে পারে।
➤ ফাঙ্গাসজনিত রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়, বিশেষ করে বন্যা-পরবর্তী সময়টাতে। এ সময় নানা রকম চর্মরোগ, চোখের অসুখ হয়। স্ক্যাবিস, আঙুলের মাঝখানে ঘা, টিনিয়া ইনফেকশন এ সময়ে খুব বেশি দেখা যায়।
➤ বন্যার সময় কৃমির প্রকোপ বেড়ে যায়।
➤ আবহাওয়া ও তাপমাত্রার তারতম্যজনিত কারণে নানা রকম ভাইরাসজনিত অসুখ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, সর্দি-কাশি, গলাব্যথা, সাইনোসাইটিস ইত্যাদি দেখা দেয়।
বন্যায় করণীয়
ডায়রিয়া
ডায়রিয়া হলে শরীর থেকে পানি ও লবণ বেরিয়ে যায়। তখন লবণ ও পানির অভাব পূরণ করাই হলো এর একমাত্র চিকিৎসা। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীকে খাওয়ার স্যালাইন বা ওআরএস না থাকলে বিকল্প হিসেবে লবণ-গুড়ের শরবত খাওয়াতে হবে। পাশাপাশি ভাতের মাড়, চিঁড়ার পানি, ডাবের পানি, কিছু পাওয়া না গেলে শুধু নিরাপদ পানি খাওয়ানো যেতে পারে। এতে শরীরে লবণ পানির ঘাটতি পূরণ হবে।
চর্ম রোগ
বন্যার পানি গোসল বা গায়ে লাগানো থেকে বিরত থাকবেন। কারণ এ পানির সংস্পর্শে বিভিন্ন চর্ম রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। সব সময় পানির সংস্পর্শে থাকার জন্য হাতে-পায়ে স্যাঁতসেঁতে ও ভেজা আবহাওয়ার কারণে ত্বক বা ত্বকের খোসপাঁচড়া, ফাঙ্গাল ইনফেকশন, প্যারনাইকিয়া, স্ক্যাবিস জাতীয় নানা ধরনের ত্বকের অসুখ হয়ে হতে পারে। এ ধরনের চর্মরোগ দেখা দিলে অবহেলা না করে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের সহযোগিতা নেওয়ার চেষ্টা করবেন।
খাবার গ্রহণে সতর্কতা
বন্যায় পচা-বাসি খাবার খেতে বাধ্য হয় অসংখ্য মানুষ। ফলে ছড়িয়ে পড়ে ডায়রিয়াসহ অন্যান্য আন্ত্রিক রোগ। খিচুড়ি খাওয়া এ সময় স্বাস্থ্যোপযোগী। খাবার প্লেট সাবান ও নিরাপদ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। পানি বেশি খরচ হয় বলে অনেকে প্রথমে একবার স্বাভাবিক পানিতে থালাবাসন ধুয়ে তারপর ফুটানো পানিতে ধুয়ে নেন। কিন্তু এটা ঠিক নয়। এতে থালাবাসনে অনেক ধরনের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে, যা পরে পরিষ্কার পানিতে ধুলেও দূর হতে চায় না। তাই খাবার গ্রহণের আগে থালাবাসন পরিষ্কার বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
মলত্যাগে সতর্কতা
বন্যার সময় মলত্যাগে সতর্কতা অবলম্বন খুব জরুরি। যেখানে-সেখানে মলত্যাগ করা উচিত নয়। এতে পেটের পীড়া ও কৃমির সংক্রমণ বেড়ে যায়। সম্ভব হলে একটি নির্দিষ্ট স্থানে মলত্যাগ করতে হবে এবং মলত্যাগের পরে সাবান বা ছাই দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। মলত্যাগের সময় কখনো খালি পায়ে থাকা চলবে না। কেননা বক্রকৃমির জীবাণু খালি পায়ের পাতার ভেতর দিয়ে শরীরে সংক্রমিত হয়। এ সময় বাসার সবাইকে কৃমির ওষুধ খাওয়ানো উচিত। তবে দুই বছর বয়সের নিচের শিশুদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
দুর্ঘটনা থেকে সাবধান
বন্যার সময় ঘটে আকস্মিক নানা দুর্ঘটনা। সাধারণত বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা, পানিতে ডুবে যাওয়া, সাপ ও পোকামাকড়ের কামড়ের ঘটনাগুলো বেশি ঘটে। এ বছরের বন্যায় সাপের কামড়ে মারা গেছে অনেক মানুষ। এ ছাড়া পানির নিচে বহু বৈদ্যুতিক টাওয়ার, খুঁটি, ট্রান্সফরমার লাইনের তার ডুবে থাকে। এসব বৈদ্যুতিক লাইনের নিচ দিয়ে নৌকা বা ভেলা চালানোর ক্ষেত্রে বা চলাচলের ক্ষেত্রে খুব সতর্ক হতে হবে। বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে গেলে বা পানিতে পড়ে থাকতে দেখলে তা স্পর্শ না করে বিদ্যুৎকর্মীদের জরুরিভাবে খবর দিতে হবে।
বন্যার আগে যেসব খাবার সংরক্ষণ করবেন
বন্যা চলাকালীন ও তার পরবর্তী সময়ে বিভিন্নরকম সংকট দেখা দিতে পারে। খাদ্য সংকট তার মধ্যে অন্যতম। আমরা সচেতন হলেই এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। যেমনঃ চাল, ডাল, আলু, লবন, মুড়ি, চিড়া, খই, নারিকেল, খেজুর, বিস্কুট, গুড়, বাদাম, বিশুদ্ধ পানি, স্যালাইন, ওষুধ।
বন্যা পরবর্তী সময়ে করণীয়
➤ বন্যা পরবর্তী সময়ে যেসব রোগ-বালাই হয়, তার সঠিক চিকিৎসা নিতে হবে। পানি নেমে গেলে বাড়িঘর সব জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। একই সঙ্গে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
➤ বন্যা শুধু শারীরিক ক্ষতিই করে না বরং মানসিক চাপও তৈরি করে। প্রলয়ংকরী বন্যাতে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষজন ভীষণভাবে দীর্ঘকালীন মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
➤ বন্যা পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত বাসস্থান ঠিক করা, অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবিলা করা ইত্যাদি বিষয়সমূহ মানসিক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
➤ বন্যা পরবর্তী সময়ে যেসব মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা, রাগ, হতাশা, অস্বাভাবিক নিদ্রালুতা, হাইপার এক্টিভিটি, ইনসোমনিয়া হতে পারে।
➤ তাই বন্যা পরবর্তী সময়ে সব ধরনের প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে সুস্থ থাকতে হবে। এ জন্য দরকার ধৈর্য ও সাহস। জীবনকে জয় করার মধ্যেই সার্থকতা। তাই বন্যা ও বন্যা পরবর্তী সময়ে নিজেকে সুস্থ রাখতে চেষ্টা করবেন। যাতে আগামী দিনগুলোর জীবনযুদ্ধে আপনি জয়ী হতে পারেন।