জরীফ উদ্দীন, উলিপুর:
মুন্সিবাড়ীর ইতিহাস –
কাসিম বাজার এস্টেটের সপ্তম জমিদার কৃষ্ণনাথ নন্দী এক খুনের মামলায় আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর বিষয়কে নিজের জন্য অবমাননাকর ও আত্মমর্যাদাহীন মনে করে ১৮৪৪ সালে ৩১ অক্টোবর নিজ বাসভবনে আত্মহত্যা করে মারা গেলে তাঁহার স্ত্রী মহারানী স্বর্ণময়ী কাসিমবাজার এস্টেটের জমিদার হন। স্বর্ণময়ী ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী ও প্রজাদরদী জমিদার। তাঁহার অধীনে মুনসেফ (মুন্সী) এর চাকরী করতেন বিনোদী লাল। বিনোদী লাল বার্ষিক একশত টাকায় ধরণীবাড়ী এস্টেটের জোতদারী ভোগ করতেন। কিংবদন্তি আছে, বিনোদী লাল মুন্সী একদিন প্রজাদের খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য অথবা পশু শিকারের জন্য বাহির হন হাতির পিঠে চড়ে। এক স্থানে এসে দেখেন একটি ব্যাঙ সাপ ধরে খাচ্ছে। প্রচলিত আছে যে স্থানে ব্যাঙ সাপ ধরে খায় সে স্থানে বাড়ি করলে অনেক ধন সম্পদের মালিক হওয়া যায়। বিহারী লাল তাই ভেবে সেখানে বাড়ি করার মনস্থির করেন। ফিরে গিয়ে তিনি মহারানী স্বর্ণময়ী কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ধরণীবাড়ীতে বাড়ি করেন। ভিন্ন জনশ্রুতিও আছে বাড়িটি নিয়ে। অনেকে বাড়িটিকে বুনোয়ারী মুন্সীবাড়ী বা বাবুর বলে থাকেন। যার কারণ হিসাবে মনে করা হয় বুনোয়ারী নামে একজন জোতদার এই বাড়িটিতে বাস করতেন। সে যাই হউক না কেন ধরণীবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের সরকারি ওয়েবে এটি রাজবাড়ী নামে উল্লেখ আছে। বর্তমান কালের স্বাক্ষী হয়ে যে অট্রালিকাটি দাড়িয়ে আছে সেটি তৈরি করেন বিনোদী লালের পালক পুত্র শ্রী ব্রজেন্দ্রলাল মুন্সী আঠারো শতকে।
লোকমুখে শোনা যায়, ব্রজেন্দ্রলাল মুন্সীর ছিল দুই মেয়ে টিতু ও বুদি। বুদি ছোট বেলায় মারা যায়। টিতু বড় হলে মুন্সী ভাবলেন, আমি ধরণীবাড়ী, বেগমগঞ্জ, মোঘলবাসা, গাইবান্ধা ও মালীবাড়ীর জোতদার কিন্তু আমার ঘর বাড়ি ভালো না হলে মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারব না। তাই তিনি দ্বিতলা অট্রালিকা তৈরি করেন। যে অট্রালিকার প্রথম তলায় ছিল বড় বড় তিনটি কামরা। মূল অট্রালিকা ছাড়াও আছে একটি মন্দির। মন্দিরের পশ্চিমে খোলা মঞ্চ, একটি তুলসীর পাঠ, মন্দিরের উত্তর-পশ্চিমে স্নানাগার। স্নানাগারের ভিতরে একটি কূপ। আর অট্রালিকার সামনে সান বাধানো একটি বড় পুকুর। অট্রালিকা তৈরি হলে মহা ধুমধামে তিনি মেয়েকে কলকাতায় বিয়ে দেন। এর পর কেটে যায় অনেক বছর। ব্রজেন্দ্রলাল মুন্সী ১৯৬০ সালে মারা যান। তাঁর কোন পুত্র সন্তান ছিল না। তবে তাঁর স্ত্রী আশলতা মুন্সীর বিহারীলাল নামে একজন পালকপুত্র ছিল। বিহারী লাল ছিলেন ভবঘুরে, মাতাল এবং নির্লোভ ব্যক্তি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছাইফুল হক যিনি তৎকালীন কোন একটি এনজিও অফিসে চাকরী সূত্রে এখানে থাকতেন। তিনি বিহারী লালকে লোভ লালসা দেখিয়ে বাড়িটি লিখে নেন। ছাইফুল পক্ষের দাবি তারা বাড়িটি কিনে নিয়েছেন। এ সংক্রান্ত বর্তমান মামলাটি দেখাশুনা করছেন ছাইফুলের বন্ধু তেলিপারার বৃদ্ধ আরিফ।
তথ্যানুসন্ধানে বেড়িয়ে আসে, ব্রজেন্দ্রলাল মুন্সী বিহারী লালকে পালকপুত্র হিসাবে গ্রহণ করেননি গ্রহন করেছিলেন আশালতা । তাছাড়া ব্রজেন্দ্রলাল মুন্সী তাঁর সমস্ত সম্পতি স্ত্রীকে দেন নি। তার স্ত্রী শুধুমাত্র প্রশাসনের বিশেষ অনুমতি নিয়ে সম্পতির অংশ থেকে দান-খয়রাত, পূজা-অর্চনা ও বিভিন্ন উন্নয়নে ব্যয় করতে পারতেন। যেখানে সম্পতি বিক্রি করা আশালতার অধিকার ছিল না সেখানে তাঁর পালক পুত্র পাওয়ার প্রশ্নেই উঠে না। এমন কি এই বাড়ি দখল মুক্ত করতে ছুটে আসা গ্রামবাসীকে ঠেকাতে গুলি করে বাদীপক্ষ যাতে চাঁদ মিয়া নামে একজন সদ্য গ্রাজুয়েট ব্যক্তি ও একজন হিন্দু যুবক মারা যান। তারপর থেকে চলে আচ্ছে সরকার ও ছাইফুল পক্ষের মামলা।
হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্বাক্ষী –
বর্তমানে বাড়িটির একটি কক্ষে ভূমি অফিস, আর একটিতে আছে অনেক পুরনো ভূমি সংক্রান্ত মোটা মোটা খাতা, ফাইল যা ভাঙ্গা তাকের উপর এবং একটি ভাঙ্গা টেবিল, ভাঙ্গা আলমারী, শ্রী ব্রজেন্দ্রলাল মুন্সীর ছবি ইত্যাদি শোভা পায়। বাকি কক্ষটি পরিত্যক্ত। সংস্কারের অভাবে একটু বৃষ্টি হলেই পানিতে ভিজে যায় কক্ষের ভিতরের অংশ। যার ফলে নষ্ট হয়ে গেছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ফাইল। ছাদের পানি পরার জন্য যে বাঘের মুখ ছিল এক সময়, তা আজ প্রতক্ষদর্শীদের বর্ণনায় পাওয়া যায়। দেওয়ালের কারুকার্যখচিত দেওয়াল আজ সংস্কারের অভাবে চাঁপা পরছে শেওলার নিচে, ভেঙ্গে পড়ছে শেষ চেষ্টায় টিকতে না পেয়ে। মন্দিরটিতে এখন আর বাজে না কাসার ঘন্টা, হয় না পূজা অর্চনা। মন্দিরের পশ্চিমে খোলা মঞ্চ আজ শুধুই কালের স্বাক্ষী, তুলসীর পাঠের অবস্থা করুণ, স্নানাগারের ভিতরের কূপটি মাটি দিয়ে ভরাট হয়েছে। ভিতরে জঙ্গলে ভরা। যাতে শোভা পায় বড় বড় গেছো শামুক।
দরকার উদ্যোগ –
অবহেলা-অযত্নে এবং স্বার্থপরতায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে উলিপুর-কুড়িগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্বাক্ষী বিখ্যাত মুন্সী বাড়ী। আজ এলাকাবাসীর দাবী, মামলা নিষ্পতি করে সংস্কার করা। অট্রালিকাটিকে ঐতিহাসিক স্থান হিসাবে সংরক্ষণ করে দর্শনীয় স্থান গড়ে তোলার। যুগযুগ বেঁচে থাকুক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বাক্ষী জমিদার আমলের ধরণীবাড়ীর স্মৃতি মুন্সীবাড়ী।
জরীফ উদ্দীন
উলিপুর, কুড়িগ্রাম।
মোবাইলঃ ০১৭১৭-০৭৪৬৭০ / ০১৯৪৪২৬৫৩৬৪