প্রকৌ. রূপম রাজ্জাক:
নূর মোহাম্মদ সরকার। বাঙলা মায়ের বীর সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। একটি পতাকার জন্য, একটি স্বাধীন ভুখন্ডের জন্য, শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে, এনেছেন রক্তিম ভোর।
নূর মোহাম্মদ সরকার ১৯৫৫ সালের ৯ই আগস্ট কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর দুর্গাপুর ইউনিয়নের গোড়াই রঘুরায় গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। নছিয়ত উল্লাহ ও ছমিরন নেছা দম্পতির আট ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। পড়াশোনার হাতেখড়ি গোড়াই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে পঞ্চম শ্রেণী এবং দুর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে এসএসসি পাশ করেন। পরে কুড়িগ্রাম ভোকেশনাল থেকে ট্রেড কোর্স করে কারিগরি শিক্ষা অর্জন করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ সরকার ৪ মেয়ে ও এক ছেলের জনক।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা রেডিওতে শোনেন নূর মোহাম্মদ। তখন তিনি দূর্গাপুর হাইস্কুলের ছাত্র। ঘোষণার পরে তিনি এবং তার সহপাঠীরা মিলে দূর্গাপুর হাইস্কুলে তালা লাগিয়ে মিছিল বের করেন। মিছিল নিয়ে তাঁরা বালাকান্দি হাইস্কুল যান, সেখানে স্কুল বন্ধ করে মিছিল নিয়ে ফরকেরহাট হাইস্কুলে যান এবং সেখানে গিয়ে সমাবেশ করেন। ওই সমাবেশ থেকে তিনি এবং তার সহপাঠীরা যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ হন। সমাবেশ শেষে বাড়ি ফিরে যুদ্ধে যাবার পরিকল্পনা করেন। এই পরিকল্পনার কথা জানান এলাকার মো. ইয়াকুব আলী সরদার ও মো. আব্দুর জব্বার আলীকে। তাদের মধ্যে মো. ইয়াকুব আলী প্রথমেই রাজি হয়ে যায়। আর আব্দুল জব্বার প্রথমে যেতে না চাইলেও পরে রাজি হন। তারপর ২৬শে মার্চ চূড়ান্ত ঘোষণা আসার পর এই তিনজন বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে সে মাসেই বলে যুদ্ধে চলে যান। এ সময় পথিমধ্যে পাশের গ্রামের আরো কয়েকজনকে পাওয়া যায় যারা যুদ্ধে যাচ্ছিলেন। সেদিনের কথা মনে হলে, স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরও নূর মোহাম্মদের চোখ ছলছল করে। পাশের গ্রামের যে বন্ধুরা যুদ্ধে যাচ্ছিল তাদের মধ্যে এক ছেলেকে তার বাবা বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য পিছুপিছু ছুটে আসেন। তারপর ছেলেটি যখন নৌকায় ওঠে নদী পার হওয়ার জন্য তখন তার বাবা নদীতে লাফিয়ে পড়ে। হতভম্ব হয়ে তীরে নৌকা ভিড়িয়ে ছেলেটিকে নামিয়ে দিতে হয়।
নূর মোহাম্মদ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে প্রশিক্ষণ নেন ১১ নং সেক্টরের অধীনে। প্রথম দিকে ভারতের আশপাশে, পরে কুড়িগ্রাম জেলার অন্তর্গত রৌমারিতে নতুন করে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হওয়ায় সেখানে প্রশিক্ষণ নেন। তারপর মাহবুবুর রহমান (চন্ডুল),নজরুল ও সোলায়মানের নের্তৃত্বে দেড় মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এদিকে প্রশিক্ষণ চলাকালে তার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কথা শুনে এলাকার রাজাকার মাওলানা মো. আব্দুল হামিদ ওরফে দাগগিল ও পাকিস্তান সমর্থিত লোকজন তার বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। ওই স্মৃতি মনে করে নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কারণে রাজাকার ও পাকিস্তানের সহযোগীরা আমাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। আমার বাবাকে হুমকি দেয় আমাকে যেন মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরিয়ে আনে। এরপর তারা আমার পরিবারের উপর নানা ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। এমনকি আমাদের ক্ষেতের পাকা ধান কাটতে দেয়নি তারা।’
প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে চিলমারী উপজেলাধীন রানীগঞ্জ এলাকার একটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে অবস্থান করেন। এই সময় ভারতীয় বাহিনীসহ তাদের ইউনিট চিলমারী আক্রমণ করেন। সেখানে অনেক আলবদর, রাজাকার ধরা পড়ে। তাদের মধ্যে মঞ্জু মিয়া ও ওলী আহম্মেদ পাকিস্তানী দোসরদের অন্যতম নেতা ছিল। রাজাকারদের হত্যার পর পাকিস্তানী ক্যাম্পটি দখল করা হয়। এ সময় ক্যাম্প থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র-সস্ত্র পাওয়া যায়।
এছাড়া বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নূর মোহাম্মদ। সেসব যুদ্ধের স্মৃতি এখনো তার চোখে জ্বল জ্বল করে, শিহরণ জাগায় বুকে। কয়েকযুগ পরেও সেইসব দিনের কথা মনে হলে বুকের ভেতর থেকে ওঠে আসে অন্যরকম শক্তি ও মাতৃভূমিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রেরণা।