।। নিউজ ডেস্ক ।।
দারিদ্রতা কখনও প্রকৃত মেধাবীদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ কুড়িগ্রামের মমিনুর ইসলাম (৩০)। দিনমজুর পিতার টানাটানির সংসারে তিনবেলা পেটপুরে খাওয়াই ছিল তাদের জন্য দুঃসহ। সেখানে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু ছিল না। সেই দরিদ্র পরিবারে আধপেটা খেয়ে নিজের স্বপ্নকে পুরণ করেছেন মমিনুর। পড়াশুনা চালিয়ে যেতে তাকে ঢাকা ও কুমিল্লায় গিয়ে রিকশা চালাতে হয়েছে। করতে হয়েছে দিনমজুরী। বেশিরভাগ সময় বাসের সিটে বসার সুযোগ হয়নি তার। ভাড়া কম দেয়ায় দাঁড়িয়েই ঢাকার পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।
অদম্য মেধাবী এই যুবক সম্প্রতি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় এনটিআরসিএ’র মধ্যে মেধা তালিকায় তৃতীয় হয়ে কুড়িগ্রাম আলিয়া কামিল মাদ্রাসায় ইংরেজি বিষয়ে প্রভাষক হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার এই প্রভাষক হওয়ার খবরে শুধু পরিবার নয়, এলাকার মানুষ, বন্ধু-বান্ধব শিক্ষকরা চমকে গিয়েছেন। আশীর্বাদ করছেন তার এই সাফল্য অর্জনে।
জেলার সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের মধ্যকুমরপুর সপপাড়া গ্রামের দিনমজুর নুর ইসলামের ছেলে মমিনুর। মায়ের নাম ময়না বেগম। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় সে। ২০০৯সালে মধ্যকুমরপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে এসএসসি এবং ২০১১ সালে নাগেশ^রী উপজেলার ভিতরবন্দ ডিগ্রি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে ইংরেজি বিষয়ে অণার্স ও মাস্টার্স শেষ করেন।
মমিনুর ইসলাম জানান, অভাবের কারণে পড়াশুনা থমকে যেতে বসেছিল। কারণ আমার বাবা-মায়ের পক্ষে পড়াশুনার খরচ যোগানো সম্ভব ছিল না। ফলে আমি বাধ্য হয়ে দিনমজুরী ও রিক্সাচালানোর কাজ শুরু করি। এলাকাবাসী ও বন্ধু-বান্ধবীদের নজর এড়িয়ে গোপনে ঢাকার কেরানীগঞ্জে গিয়ে রিক্সা চালাতাম। যা টাকা আয় হতো সেই টাকা দিয়ে প্রাইভেট আর বই কেনার কাজে ব্যবহার করতাম। কখনো কখনো এলাকার মজুর ভাইদের সাথে কুমিল্লা গিয়েছি ক্ষেত-খামারে কাজ করতে। কিন্তু আমি কখনো দমে যাইনি। হতাশ হয়েছি কিন্তু পড়াশুনার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুৎ হয়নি। তাই অভাবী পরিবারের শিক্ষার্থীদের কাছে অনুরোধ করবো, তোমরা কখনো ভেঙ্গে পরবে না। নিজের ভবিষ্যতের জন্য পড়াশুনা চালিয়ে যেতে প্রয়োজনে দিনমজুরী করবে। এতে লজ্জ্বার কিছু নেই। তোমার অদম্য ইচ্ছে তোমাকে লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করবে। মমিনুরের স্বপ্ন এখন বিসিএস ক্যাডার হওয়া। সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে সে।
মমিনুরের বাবা নুর ইসলাম জানান, দিনমজুরী করে কোন রকমে সংসার চালাতাম। এই ছেলেকে আমি কোন কিছু দিতে পারি নাই। সামান্য কাপড়টাও অন্যের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে কলেজে গেছে। নিজে মজুরী করে শ্রম দিয়ে পড়াশুনা করেছে। তার চাকুরীর খবর পেয়ে আমি আল্লাহর কাছে হাত তুলে শুধু কেঁদেছি। আমার এই সন্তান যেন সুখে থাকে। অন্য সন্তানরা যাতে আমার সন্তানের মতো কষ্ট না পায়।মমিনুরের মা ময়না বেগম জানান, বাড়ী থেকে হেঁটে অনেক কষ্ট করে স্কুল-কলেজ গেছে। পরে বাপের বাড়ী থেকে একটা পুরাতন সাইকেল সংগ্রহ করে ছেলেকে দিয়েছি। তাতেই ছেলে খুশি। ছেলেকে ভালমন্দ খাওয়াতে পারিনি। আল্লাহ চোখ তুলে চেয়েছে। আপনারা সবাই আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন।
কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন জানান, মমিনুর একজন মেধাবী ছাত্র। সে ১৬তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় সারাদেশ থেকে মেধা তালিকায় তৃতীয় হয়েছে। গত ১০ মার্চ সে কুড়িগ্রাম আলিয়া কামিল মাদ্রাসায় ইংরেজী বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেছে। আমাদের কলেজে থাকার সময় আমরা যতটা পেরেছি তাকে সহযোগিতা করেছি। বাকীটা নিজের অদম্য ইচ্ছেশক্তিতে সে সফলতা লাভ করেছে। আমরা মনে করি মমিনুরকে দেখে অন্য শিক্ষার্থীরা উজ্জীবিত হবে।