|| রূপম রাজ্জাক ||
চ্যাটজিপিটি নামক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশনটির অসামান্য সক্ষমতা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। এত অল্পসময়ে এতটা হইচই ফেলে দেয়ার মতো প্রযুক্তি সাম্প্রতিক সময়ে আর দ্বিতীয়টি নেই। এর সক্ষমতা যখন অনেক কাজকে সহজ করে দিচ্ছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই অনেকের মনে শঙ্কা কাজ করছে যে হয়তোবা অনেক ধরনের কাজে এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু হলে অনেকেই চাকরি হারাতে পারে। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাপী আলোচনা চলছে। বিশেষ করে গুগলের মতো টেক জায়ান্ট চ্যাটজিপিটির অনুকরণে অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে আসার ঘোষণা দেয়ার পরে এই বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এর মূল প্রভাব পড়বে দাপ্তরিক, প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত কাজের ক্ষেত্রগুলোতে (যেগুলোকে হোয়াইট-কলার কাজ বলা হয়) যেসব কাজে নতুনত্বের প্রয়োজন তুলনামুলকভাবে কম। যুক্তরাষ্ট্রের রচেস্টার ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক পেংচেং শি নিউইয়র্ক পোষ্টকে বলেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হোয়াইট-কলার চাকরিজীবিদের জায়গা দখল করতে শুরু করেছে। তার মতে, এটি কারও পক্ষেই থামানো সম্ভব না।
তো আরেকটু দেখে নেয়া যাক চ্যাটজিপিটির কারণে আগামী দিনে কোন কোন ধরনের চাকরির ক্ষেত্রগুলোতে মানুষের প্রয়োজন কমে আসতে পারে।
গ্রাহক সেবাঃ
যেহেতু চ্যাটজিপিটির প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে পূর্বে ব্যবহৃত কোটি কোটি প্রশ্ন ও উত্তরকে কাজে লাগিয়ে সবচেয়ে ভালো উত্তরটি দেয়া, তাই গ্রাহক সেবার মতো কিছু খাত যেখানে ইতিমধ্যেই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে সেসব ক্ষেত্রে চ্যাটজিপিটি ব্যাপকভাবে ভূমিকা রাখবে। মানুষের চাইতেও দ্রুততার ও শুদ্ধতার সাথে উত্তর দেয়ার কাজটি চ্যাটজিপিটি করতে পারছে বলে সামনের দিনগুলোতে কর্মসংস্থানের সংকোচন হবে। তবে অনেকের মতে, স্পর্শকাতর অনেক ব্যাপারেই মানুষের বিচারবুদ্ধির উপর নির্ভর করতেই হবে। তবে কর্মসংস্থান কমে যাবে এ ব্যাপারে মোটামুটি সবাই একমত।
কনটেন্ট লেখা ও সম্পাদনাঃ
বিজ্ঞাপন সম্পর্কিত কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে, আইনি সহায়তায়, সাংবাদিকতায় বা কারিগরি বিভিন্ন বিষয়সহ দৈনন্দিন নানান ক্ষেত্রে লেখালেখি বা সম্পাদনায় স্বাতন্ত্রতা আনতে যে সময় ও শ্রম দিতে হয়, চ্যাটজিপিটি তা নিমিষেই করে দিতে পারছে। ইতিমধ্যেই ব্রাউজারভিত্তিক বিভিন্ন এক্সটেনশনসহ অনেক সফটওয়ার চ্যাটজিপিটিকে ব্যবহার করে দ্রুততার সাথে কনটেন্ট তৈরি করে দিচ্ছে। কোনো একটি বিষয়কে স্পষ্ট করে চ্যাটজিপিটিকে জিজ্ঞেস করলে সে জানিয়ে দেয় তার বিবরণে কতটি অধ্যায় বা প্যারা থাকা উচিত, সেগুলোর নাম বা হেডলাইন কি কি হবে, এমনকি কোন অধ্যায় বা প্যারার বর্ণনায় কি লেখা উচিত ইত্যাদি সবকিছুই চ্যাটজিপিটি করে দিতে পারছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অনেক প্রতিষ্ঠান ভাবতে শুরু করেছে কিভাবে ১০ জনের কাজকে ২ জন দিয়ে করানো যায়। কারণ, মূল লেখার কাজটি চ্যাটজিপিটি করে দিলে শুধুমাত্র সেগুলোকে পরীক্ষা করে সমন্বয় করতে খুব বেশি জনবলের প্রয়োজন হবে না।
সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টঃ
চ্যাটজিপিটি অত্যন্ত সুচারুভাবে কোড লিখে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, সাথে ধারা বর্ননাও লিখে দিচ্ছে। ফলে সঠিক প্রম্পট ব্যবহার করে চ্যাটজিপিটি থেকে সহজেই কোড লিখে নেয়া যাচ্ছে বিভিন্ন প্রোগ্রামিং ভাষার। চ্যাটজিপিটি হয়তো পুরো একটি সফটওয়ার প্রকল্প করে দিতে পারছে না, কিন্তু প্রকল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রয়োজনীয় স্বাধীন কোড ব্লক লিখে দিতে পারছে। ফলে একজন মোটামুটি দক্ষ প্রোগ্রামার বা টিম লিডার চাইলেই টিমে স্বাভাবিকের চাইতে কম সংখ্যক সদস্য দিয়েই অনেক কাজ সম্পন্ন করতে পারবে। বিশেষ করে জুনিয়র বা এন্ট্রি লেভেলের প্রোগ্রামারের প্রয়োজন অনেকাংশে কমে যাবে। বড় বা প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো হয়তো দীর্ঘমেয়াদের ভাবনা মাথায় রেখে জুনিয়র বা এন্ট্রি লেভেলের প্রোগ্রামার নিয়োগ অব্যাহত রাখবে, কিন্তু ছোট কোম্পানিগুলো ব্যয় কমাতে চ্যাটজিপিটির সহায়তা নিবেই। ফলে চাকরির বাজারে এর প্রভাব পড়তে পারে।
ওয়েবসাইট ও গ্রাফিক ডিজাইনঃ
সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের মতোই প্রভাব পড়বে এই ক্ষেত্রেও। ইতিমধ্যেই চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে মোটামুটি মানের ওয়েবসাইট তৈরি করা যাচ্ছে খুব সামান্য সময়ের মধ্যে। ফলে দক্ষ পেশাজীবী যারা যাচাই বা মান নিয়ন্ত্রনের কাজ করেন তাদের বাইরে জুনিয়র পর্যায়ের লোকবল লাগবে না। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর চিন্ময় হেজের মতে, এই কাজের পেশাজীবীগণ যারা সাধারণ পর্যায়ের বা অল্প জটিল কাজ করে থাকেন তারা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বেন।
শিক্ষকতাঃ
একজন শিক্ষক ক্লাসরুমে নির্দিষ্ট সময়ে যতটুকু পড়াতে পারেন, চ্যাটজিপিটি তার চাইতে অনেক বেশি তথ্য বা বেশি রকমের সমাধান উপস্থাপন করতে পারে। গবেষকরা বলেছেন, ভবিষ্যতের ক্লাসরুমে শিক্ষকের ভুমিকায় আসবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর এর পরিচালনায় একজন ইন্সট্রাক্টরই যথেষ্ট হবে। অধ্যাপক পেংচেং শি’র মতে, “চ্যাটজিপিটি ইতিমধ্যেই ক্লাসে পড়াতে পারছে। যদিও তার জানায় কিছু কিছু ভুল আছে কিন্তু প্রশিক্ষনের মাধ্যমে তা সহজেই উন্নতি করা সম্ভব।”
আর্থিক, গবেষণা ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা খাতঃ
বিভিন্ন ধরনের গবেষণা, তথ্য উপাত্ত যাচাইয়ের কাজ, আর্থিক বিশ্লেষণ, বাজার বিশ্লেষণ ও এর প্রবণতার চিত্র, তথ্যের ভিত্তিতে প্রেডিকশন বা ভবিষ্যদ্বাণী, চাকরির প্রার্থী বাছাই ও নিয়োগ প্রক্রিয়া ইত্যাদি কাজের ক্ষেত্রগুলোতে যে লোকবল দিয়ে তথ্য সংগ্রহ, যাচাই ও সমন্বয়ের কাজ করতে হয়, তার বৃহৎ অংশেরই কাজ প্রতিস্থাপন করে দিবে চ্যাটজিপিটির সক্ষমতা। চ্যাটজিপিটি তার ভান্ডার থেকে প্রায় নির্ভুল তথ্য দিতে পারে। ফলে এসব খাতে অনেক কম জনবলের প্রয়োজন পড়বে।
বাংলাদেশে এর প্রভাবঃ
আমাদের দেশের স্থানীয় বাজারের গতানুগতিক কাজের ক্ষেত্রগুলোতে এর প্রভাব হয়তো সহসাই পড়বে না। কিন্তু যারা দেশে বসে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত আছেন, তাদের উপর প্রভাব আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই পড়তে শুরু করবে বলে ধারনা করা যায়। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মত, আগামী ৩-৫ বছরের মধ্যে অনেক ধরনের কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্বয়ংক্রিয় ব্যবহার বেড়ে যেতে বাধ্য। তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার ও প্রয়োগে দক্ষ জনবলের প্রয়োজন বাড়বে।
তাই আপনার কাজ দেশে হোক বা বিদেশে হোক, নিজের বর্তমান কাজকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের মাধ্যমে আরও গতিশীল করার ব্যাপারে ভাবুন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইদানীং একটি কথা বেশ প্রচলিত – “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সরাসরি আপনাকে প্রতিস্থাপন করবে না। করবে কেউ একজন ব্যক্তি যে কিনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঠিক ব্যবহার জানে।”।
(তথ্যসূত্রঃ নিউইয়র্ক পোষ্ট, ফোর্বস ম্যাগজিন ও বিজনেস ইনসাইডার।)
লেখক –
রূপম রাজ্জাক
তথ্য প্রযুক্তিবিদ ও সাংবাদিক
(ডেটা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত)
লন্ডন, যুক্তরাজ্য।