|| রূপম রাজ্জাক ||
আমাদের দেশে সাধারণত রাজধানী ঢাকার বায়ুর মানের সূচক বা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (AQI) নিয়ে আলোচনা হয়। সেটাও হয় যখন সেই AQI সর্বোচ্চ মাত্রায় খারাপ থাকে। আর এসব আমরা জানতে পারি শুধুমাত্র যখন জাতীয় পত্রিকাগুলো লেখে বা নিউজ করে। কিন্তু জাতীয় গণমাধ্যম স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে প্রতিদিন নিউজ করে না। যেদিন বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ে যায় সেদিন হয়তো নিউজ করে। তবে আমরা কি জানি ঢাকার বাইরের শহরগুলোতেও এয়ার কোয়ালিটি ইনডেএক্সের অবস্থা খারাপের মধ্যেই থাকে? AQI পরিসংখ্যান বলছে, যারা ঢাকায় থাকেন না তাদের নিজেদেরকে খুব একটা নিরাপদ ভাবার কারণ নেই। কারণ ঢাকার বাইরের বায়ুর দূষণ ঢাকার মতো ‘অতিরিক্ত খারাপ’ না হলেও স্বাস্থ্যকর অবস্থায় নেই।
AQI কে মূলত কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। ইনডেক্স ০-৫০ কে ভালো ধরা হয়। ৫১-১০০ কে মোটামুটি ভালো ও ১০১-১৫০ কে সংবেদনশীল শ্রেণী মানুষের জন্য ক্ষতিকর/অস্বাস্থ্যকর ধরা হয়। এরপরের ধাপে ১৫১-২০০ কে সবার জন্যই অস্বাস্থ্যকর হিসেবে ধরা হয়। AQI ইনডেক্স ২০১-৩০০ কে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বিবেচনা করা হয়। সর্বশেষ গ্রুপে ইনডেক্স ৩০১ ও তার বেশি হলে তা বিপজ্জনক বলে বিবেচনা করা হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের AQI এর তথ্য ঘাটলে দেখা যায় বায়ুদূষণ প্রায় সবসময়ই অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে থাকে।
আমি যখন এই লেখাটি লিখছি (বাংলাদেশ সময়, ২০ই ফেব্রুয়ারি ২০২৩, সোমবার সকাল ৭টায়) তখন বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভাগের ৩০টি জেলার AQI মাত্রা দেখে একটিতেও ১০০ এর নিচে পাইনি। বরং বেশ কয়েকটি জেলায় এই মাত্রা ১৫০ এর অনেক উপরে ছিল। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক, যেখানে AQI ছিল ৯৯। তার মানে কমবেশি অস্বাস্থ্যকর মানের বায়ুই বিরাজ করছে গোটা দেশে।
বায়ুদূষণ অনেক কারণেই হয়। অপরিকল্পিত শিল্পায়নের ফলে হয় তা সবার জানা। যানবাহন ও কৃষিবর্জ্যের ধোঁয়া থেকে হয়। ফসলে/বাগানে কীটনাশক ব্যবহারের ফলেও হয়ে থাকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার বাইরে অসংখ্য অপরিকল্পিত ও অবৈধ ইটভাটার সৃষ্ট দুষিত বায়ু দেশের অন্যতম বড় পরিবেশ-ঘাতক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে দেশের প্রত্যন্ত অনেক গ্রামেও বায়ুর মান মারাত্মক রকমের খারাপ হয়েছে।
একটি গবেষণায় এসেছে, ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব শহরের বায়ু বছরে ৩৬৫ দিনের ৩০০ দিনই মারাত্মক দূষিত অবস্থায় থাকে। গবেষকরা বলছেন, এরকম AQI পরিস্থিতিতে একজন মানুষের আয়ু ৮-১০ বছর পর্যন্ত কমতে পারে এবং জীবদ্দশায় বিভিন্ন রোগশোক লেগেই থাকবে। অন্য একটি গবেষণায় পাওয়া গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর বায়ুদূষণে প্রায় ৮৮ হাজার মানুষ মারা যান। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। বায়ুদূষণের ফলে শরীরে যেসব বস্তুকণা প্রবেশ করে তা সর্দি, কাশি, যক্ষ্মা ও নিউমোনিয়ার মতো রোগের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটায়। মেজাজ খিটখিটে তো বটেই এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতাও চলে আসে।
বলছিলাম AQI এর উপর গণমাধ্যমের নিউজ নিয়ে। যেহেতু প্রতিদিন নিউজ হয়না, তাই অনেকসময় AQI খুব খারাপ থাকলেও জনগণ তা জানতেই পারে না। কিন্তু এটি সবসময়ই জানা যেতো যদি সরকার নিজ দায়িত্বে দেশের বিভিন্ন শহরের/জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ডিসপ্লে বসিয়ে রিয়্যাল টাইম AQI সহ এ সম্পর্কিত তথ্য শেয়ার করতো। আমাদের দেশের সরকার বায়ুদূষণ ঠেকাতে পারেনি বা দৃশ্যমান উদ্যোগও নেয়নি। কিন্তু দূষিত বায়ুর ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে হালনাগাদ তথ্য দিতে পারতো। এ কাজটি করলে কোটি কোটি মানুষ সাবধান হতে পারতো বা ক্ষতির পরিমাণ কমাতে নিজেরাই সক্রিয় হতো।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শহরে শহরে রিয়্যাল টাইম AQI দেখানোর ডিসপ্লে থাকে যেখানে বিভিন্ন সচেতনতামূলক পরামর্শও দেয়া থাকে। উন্নত দেশগুলো এ ব্যাপারে খুবই তৎপর। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের রাজধানী দিল্লিতেও সেরকম ব্যবস্থা আছে। সেদেশে এই বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা সমালোচনা হয়ে থাকে এবং সরকারও বিভিন্ন রকমের উদ্যোগ নেয়। শুধু তাই নয়, AQI ইনডেক্সের মাত্রার উপর ভিত্তি করে মাঝে মাঝে সরকার স্কুলগুলো বন্ধ ঘোষণা করে। কারণ দূষিত বায়ু শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এছাড়া সর্বসাধারণের জন্য জরুরি দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে সেখানকার সরকার। আমাদের দেশেও সরকার ঢাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে এ ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে। শিশু/বৃদ্ধ বা প্রয়োজনে সর্বসাধারণের জন্য আলাদা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। সরকারি ওয়েবসাইট এমনকি টেলিভিশনের স্ক্রলেও সবসময়ের জন্য সতর্কতা বার্তা দেখানো যেতে পারে। জনস্বার্থে এ ধরনের উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি। আশা করি শীঘ্রই সরকারের সুবিবেচনার পরিচয় দেবে।
তবে সরকার করুক বা না করুক, সচেতন মানুষ নিজেরাই কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে চলতে পারে। যেমন – আমরা নিজেরাই এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের উপর নজর রাখতে পারি বিভিন্ন ওয়েবসাইটে চোখ রেখে বা মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে। আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রায়ই ঢাকার AQI এর খোজ রাখি IQAir নামক একটি অ্যাপের মাধ্যমে (স্ক্রিনশট সংযুক্ত)। অ্যাপ বা ওয়েবসাইট শুধু ইনডেক্স দেখাবে না, পাশাপাশি কতগুলো রিকমেন্ডেশনও দিয়ে থাকে। যেমন- যেদিন AQI খুব খারাপ থাকবে সেদিন ঘরের বাইরের কাজ কম রাখতে হবে বা পারতপক্ষে এড়িয়ে চলতে হবে। সামর্থ্য থাকলে ঘরে বায়ু পরিশোধক ব্যবহার করার পরামর্শও দেয়া হয়। বাইরে যদি যেতেই হয় সেক্ষেত্রে মাস্ক ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়া হয়।
বিশুদ্ধ বায়ু সকলের মৌলিক অধিকার। তবে তা নিশ্চিত করতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়েও সকলের সচেতনতা প্রয়োজন।
লেখক –
রূপম রাজ্জাক
তথ্য প্রযুক্তিবিদ ও সাংবাদিক
লন্ডন, যুক্তরাজ্য।