।। নিউজ ডেস্ক ।।
চালাঘর একটি। নেই কোনো বেড়া-দরজা-জানালা। দূর থেকে মনে হয় যেনো টং ঘর। বেঞ্চ ২টি ও ৩ শ্রেণির তিন শিক্ষার্থী নিয়ে চলছে শিক্ষাকার্যক্রম। বাস্তবে আছে শুধু পতাকা, সাইনবোর্ড আর শিক্ষক। নেই কোনো সড়ক পথ যেখানে যেতে হবে জমির আইল দিয়ে। এ যেন ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধারাম সরদার। শিক্ষার্থী আর অবকাঠামো না থাকলেও নাম তার উত্তর মাঝের আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
সরেজমিনে দেখায় যায়, চারদিকে কৃষি জমি থাকায় ধান রোপনে ব্যস্ত সময় পার করছেন এখানকার কৃষকরা। জমির মাঝখানে চোখে পড়ে একটি টিনের চাল। শুধুমাত্র টিনের চালার সামনে বাঁশের মধ্যে লাগানো জাতীয় পতাকা পতপত করে উড়ছে। এর সামনে একটি সাইনবোর্ডে লেখা ‘উত্তর মাঝের চর আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। দুটি ভাঙ্গা ব্রেঞ্চ আর কয়েকটি প্লাস্টিকের চেয়ার এবং একটি মাত্র টেবিলের উপর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর হাজিরা খাতা। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮০জন থাকলেও সেখানে ৩য় শ্রেণির একজন, ৪র্থ শ্রেণির একজন ও ৫ম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকসহ বসে আছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। নেই কোন শিক্ষার্থীর কোলাহল কিংবা শিক্ষকদের পাঠদানের জন্য ব্যস্ততা। বিদ্যালয় যাবার পথ না থাকায় যেতে হবে জমির আইল বেয়ে। না এটা কোন ছবি বা কল্প কাহিনীর গল্প নয়। এটাই বাস্তব সত্য ঘটনা। এমন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দৃশ্যের খোঁজ পাওয়া যায় কুড়িগ্রাম সদরের মোগলবাসা ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে। বিদ্যালয়ের চিত্র দেখে জরাজীর্ণ বললেও ভুল হবে। বিদ্যালয়টিতে শুধু মাত্র কাগজ কলমে। শিক্ষার্থী না থাকলেও কর্মরত ৫জন শিক্ষক।
অনুসন্ধানে জানাযায়, কুড়িগ্রাম সদরের মোগলবাসা ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর মৌজায় ২০০৪সালে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে উত্তর মাঝের চর আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিন্তু নিচু স্থান হওয়ায় বন্যার পানিতে ডুবে থাকে বছরের অধিকাংশ সময়। তাই ২০১১সালে পাশেই উত্তর মাঝের চর গ্রামে উঁচু স্থানে স্থানান্তরিত করা হয় বিদ্যালয়টি। সেখানে থাকাকালিন ২০১৮সালে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হয়। গত বছরের বন্যায় ধরলা নদীর ভাঙ্গনে একই ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী চর কৃষ্ণপুর গ্রামের চর কৃষ্ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভেঙ্গে যায়। এরপর সেই বিদ্যালয়টিও স্থানান্তরিত করা হয় উত্তর মাঝের চর গ্রামেই। পাশাপাশি দু’টি বিদ্যালয়ের অবস্থান হওয়ায় উত্তর মাঝের চর আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ভূমি জটিলতা থাকার কারণে পূর্বের স্থানে স্থানান্তর করার নির্দেশ দেয় উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। এরপর থেকেই বিদ্যালয়ের এমন চিত্র হলেও কর্তৃপক্ষের ভ্রুক্ষেপ নেই। বিদ্যালয়ের পরিবেশ না থাকায় সন্তানদের ভর্তি করাচ্ছেন না অভিভাবকরা।
উত্তর মাঝের চর আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক আশরাফিয়া বিনতে আকতার বলেন, বিদ্যালয়ে আসার কোন পথ নেই। জমির আইল দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হয়। পানি ও সেনিটেশনেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। এজন্য বাচ্চারা বিদ্যালয়ে আসে না। বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণী হতে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রায় ৮০জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এরমধ্যে ১০/১৫জন শিক্ষার্থী আসে বাকি সব অনিয়মিত। জমির আইল ভেজা থাকায় প্রায় সময় পিছলে পরে আহত এবং পোশাক নষ্ট হয় শিক্ষার্থীদের।
অভিভাবক কাজলি বেগম বলেন, স্কুলের ঘর নেই শুধু পতাকা, সাইনবোর্ড আছে। এটা নামেমাত্র এটি স্কুল।
অভিভাবক লাইলী বেগম বলেন, সরকারি স্কুল হলেও এখানে ঘর, ব্রেঞ্চ, টিউবওয়েল, ল্যাট্রিন এমন কি স্কুল আসার রাস্তাও নেই। এমন পরিবেশে কোন অভিভাবক কি তার সন্তান দিতে পারে? আর যারা এই বিদ্যালয়টিতে পরে শিক্ষার পরিবেশ না থাকায় কেউ পড়তে যাচ্ছে না।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলতাফ হোসেন বলেন, বিদ্যালয় স্থানান্তর আর জমি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে এমন করুণ চিত্র। দানকৃত জমিতে দাগ নাম্বারের সমস্যার কারণে নতুন ভবন হচ্ছে না। অথচ একই মালিকের জমি বিদ্যালয়ের চারপাশে। বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের জন্য বরাদ্দ আসলেও অর্থ ছাড় হচ্ছে না জমি জটিলতার কারণে।
জমিদাতা ও ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, আমি একবিঘা জমি দান করেছি বিদ্যালয়ের নামে। এখন জমি সংক্রান্ত কি জটিলতা হয়েছে তারাই ভালো জানে। প্রায় দু’বছর থেকে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি না থাকা এবং বিদ্যালয়ের উন্নয়ন না হবার জন্য সংশ্লিট কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেন তিনি।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তা কানিজ আখতার কাছে বিদ্যালয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী না থাকায় প্রধান শিক্ষক এবং সহকারি শিক্ষকদের অফিসে তলব করা হয়েছে। এ ব্যাপারে লিখিত ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। এছাড়া জমির যে জটিলতা রয়েছে তা দ্রুত সমাধান করার কথাও বলা হয়েছে।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসার লুৎফর রহমান বলেন, জমি সংক্রান্ত সমস্যা থাকায় ভবন করা যাচ্ছে না। সদর এসিল্যান্ডসহ (ভূমি কর্মকর্তা) বিদ্যালয়ের স্থান পরিদর্শন করা হয়েছে। এবং জমি সংক্রান্ত জটিল দূর করতে প্রধান শিক্ষককে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রধান শিক্ষককের অবহেলার কারণে বিদ্যালয়ের নাজুক অবস্থা।