।। নিউজ ডেস্ক ।।
বর্তমান সময়ের একটি জটিল রোগ ফ্যাটি লিভার। দিন দিন বাড়ছে এ রোগের আক্রান্তের সংখ্যা। তবুও কঠিন এই রোগ নিয়ে সচেতনতা নেই কারও মধ্যেই। লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমলে সেটিকে ফ্যাটি লিভার বলা হয়। যাদের ওজন বেশি, ডায়াবেটিস বা প্রি-ডায়াবেটিস আছে, তাদের এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত ওজন, ডায়াবেটিস, উচ্চ কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপের কারণেও অনেকেই ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হন। আর পশ্চিমা সমাজে লিভারে চর্বি জমার প্রধান কারণ হলো অ্যালকোহল। এ ছাড়াও বিভিন্ন ওষুধ সেবন অথবা অন্যান্য রোগের কারণেও ফ্যাটি লিভার হয়ে থাকে। আবার কম ওজনের মানুষেরও হতে পারে, সেটিকে লিন ফ্যাটি লিভার বলা হয়। লিভারের চর্বি জমার ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই। বাচ্চাদের মধ্যেও এখন এই রোগের হার প্রায় ১৫ শতাংশ। এজন্য বাচ্চাদের প্রতি সতর্ক থাকতে হবে, বিশেষ করে যেসব বাচ্চার ওজন বেশি।
ফ্যাটি লিভার অনেকটাই নীরব ঘাতক। প্রথম দিকে কেউই এ সমস্যার কথা জানতে পারেন না। শুরুর দিকে লিভারের চারপাশে কিছু চর্বি জমা হয় এবং অন্য কোনো লক্ষণ থাকে না। আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে গিয়ে ধরা পড়ে।
এরপর ধীরে ধীরে সেখানে প্রদাহ শুরু হয়। এ সময় লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুরুতে শরীরে শক্তি কমে যায় ও দুর্বল অনুভব করে। ক্ষুধা কমে যায়, জন্ডিস হতে পারে এমনকি শরীরের বিভিন্ন অংশ, চোখ, মুখ, হাত হলুদ হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চললে হাত-পায়ে পানি জমতে পারে। অনেক সময় রক্ত বমিও হয়। এরপরও চিকিৎসা না করালে সেটি লিভার ক্যানসারে পরিণত হতে পারে।
লক্ষণ ও উপসর্গ
ফ্যাটি লিভার নীরব একটি রোগ যা সাধারণত উল্লেখযোগ্য কোনো উপসর্গ তৈরি করে না। তবে ক্লান্তি বা অবসাদ অনুভূত হতে পারে, ফ্যাটিলিভারের রোগীদের মাঝে যাদের ডায়াবেটিস থাকে তাদের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি লিভার রোগের আশঙ্কা বেশি থাকে। আর যারা নন-অ্যালকোহলিক স্টেটো হেপাটাইটিস বা ন্যাশে ভোগেন তাদের দীর্ঘমেয়াদি লিভার প্রদাহের একপর্যায়ে লক্ষণ প্রকাশিত হতে শুরু করে। ন্যাশে আক্রান্ত রোগীদের প্রায় ৪০ শতাংশের মধ্যে লিভার সিরোসিস (লিভার সংকুচিত হয়ে কার্যক্ষমতা হ্রাস পায় ও রক্তপ্রবাহে বাঁধার সৃষ্টি হওয়া) দেখা দিতে পারে।
তবে লিভার সিরোসিস হবার পরও প্রায় ১০ বছর পর্যন্ত তা সহনীয় পর্যায়ে থাকতে পারে। অর্থাৎ এই সময়ে রোগী ক্লান্তি, অবসাদ, দুর্বলতা অনুভব করলেও কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়া ছাড়া লিভার তেমন কোনো জটিলতা ছাড়াই তার কার্যক্রম চালিয়ে নেয়।
এ পর্যায়ে অতিক্রান্ত হলে লিভার সিরোসিসের নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে, যেমন পেটে, পায়ে পানি আসা, খাদ্যনালিতে শিরা ফুলে গিয়ে স্ফীত শিরা ফেটে রক্তক্ষরণ হওয়া, মস্তিষ্ক ও কিডনির বৈকল্য দেখা দেয়।
ফ্যাটিলিভারের চিকিৎসা
এনএএফএলডি বা ফ্যাটিলিভারের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই। কোনো ওষুধ দ্বারাই সরাসরি লিভারের চর্বি নির্মূল করা সম্ভব নয়। এ লক্ষ্যে বেশ কিছু ওষুধ ইতোমধ্যে গবেষণার বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। তবে অনুমোদিত ওষুধ না থাকলেও বেশ কিছু সমীক্ষা ও ট্রায়ালে দেখা গেছে কিছু ওষুধ যা ডায়াবেটিস ও অন্যান্য রোগে ব্যবহৃত হয় ও কিছু ভিটামিন (যেমন ‘ই’ ভিটামিন) ফ্যাটিলিভারের প্রদাহ ও ফাইব্রোসিস কমাতে সাহায্য করে। এখন পর্যন্ত খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ও শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়ামের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।
শরীরের ওজন কমানো (কমপক্ষে শতকরা ১০ ভাগ) প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসায়। এক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন খুবই জরুরি। শর্করা জাতীয় খাবার যেমন ভাত, রুটি, পাউরুটি, আলু ইত্যাদি পরিমাণে কম খেতে হবে। শাকসবজি, তাজা ফলমূল স্বাভাবিক পরিমাণে খেতে পারবেন।
পর্যাপ্ত মাছ (তৈলাক্ত অংশ ছাড়া) খেতে পারবেন তবে জাঙ্কফুড, তৈলাক্ত ও ভাজাখাবার, মাংস, চর্বিযুক্ত খাবার ও কেক-পেস্ট্রি, আইসক্রিম ইত্যাদি ক্যালরিযুক্ত খাবার গ্রহণ থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকতে হবে।
নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করতে হবে; অন্তত ৩০ মিনিট দৈনিক একটু জোরে হাঁটা কার্যকর একটি ব্যায়াম ওজন কমানোর জন্য পশ্চিমা বিশ্বে প্রয়োজনে ব্যারিয়াট্টিক অস্ত্রোপাচার করে পাকস্থলিকে ছোট করে দেওয়া হয়, আমাদের দেশে এটি এখনো প্রচলিত নয়।
ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, রক্তের কলস্টেরলের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চিকিৎসা করতে হবে।
ফ্যাটিলিভারের কারণে যদি লিভার সিরোসিস ও এর জটিলতাগুলো দেখা দেয়, এ পর্যায়ে সাধারণ চিকিৎসার পাশাপাশি প্রয়োজনে লিভার প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে একজন সুস্থ ব্যক্তির লিভারের অংশ রোগীর দেহে প্রতিস্থাপন করার মাধ্যমে রোগীর স্বাভাবিক জীবনযাপন পুনঃনিশ্চিত করা যায়।