।। নিউজ ডেস্ক ।।
৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে একই পরিবারের ৬ জন শহীদ হয়। স্বাধীনতার এত বছর পরেও পরিবারটি অভাব অনটনে মানবেতর জীবন যাপন করছে। স্বাধীনতার জন্য এই ৬ শহীদের আত্মত্যাগের কথা আজ আর কেউ স্মরণ করে না। অপেক্ষা আর অবহেলার কারণে চির নিদ্রায় শায়িত এই শহীদের কবর স্থান নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।
উলিপুর পৌর শহরের মধ্যপাড়া গ্রামের তরিফত ব্যাপারী ও তার পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে পাক বাহিনীর বর্বর হত্যাকান্ড, নির্যাতন, অত্যাচার মেনে নিতে পারেনি। স্বাধীনতার জন্য তারা শত্রু পক্ষের সংবাদ সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করতেন।
১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় একদল মুক্তিযোদ্ধা উলিপুর ডাক বাংলায় অবস্থানরত পাক বাহিনীর উপর পরিকল্পনা গ্রহণ করে তরিফত ব্যাপারীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এরপর পাক বাহিনীর সাথে রাতভর সম্মুখ যুদ্ধে পাক সেনারা তাদের পরাজয় বুঝতে পেরে কুড়িগ্রাম ক্যাম্পে খবর দেয়। পরদিন ৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম থেকে রেল ভর্তি পাক সেনারা উত্তর এবং উলিপুর ক্যাম্প থেকে দক্ষিণ দিকে বৃষ্টির মতো গুলি চালিয়ে গ্রামটি ঘিরে ফেলে। এর আগে মুক্তিযোদ্ধারা ঐ স্থান ত্যাগ করে চলে যায়। শুরু হয় গ্রামের নিরীহ মানুষ গুলোর উপর অত্যাচার। ঘর-বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার কারণে তরিফত ব্যাপারীর বড় ভাই জনাব আলী (৬০), আব্দুল জলিল ওরফে কমল (৩৫), আজিজুল হক(৩২), জামাতা ময়েন উদ্দিন(৩২), ভাতিজা কছির উদ্দিন(৪০) ও ফরমান আলী (১৮) কে আটক করে রেল লাইনের পার্শ্বে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করে গুলি করে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে জলিল আহত হয়ে মৃত্যুর ভান করে মাটিতে পড়ে থাকে। পাক সেনারা চলে গেছে ভেবে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে এক পাকসেনা দেখে ফেলে এবং পুনরায় ফিরে এসে তাকে গুলি করে হত্যা করে। পাক-সেনারা গ্রাম ছেড়ে গেলে এলাকায় স্বজনহারা মানুষের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠে। ভাগ্যক্রমে তরিফত ব্যাপারীর পুত্র আব্দুল জব্বার মন্টু পার্শ্ববর্তী নাজিম খাঁ ইউনিয়নে কোন এক কাজে গিয়ে আটকা পড়ে। দুঃসংবাদ শুনে মন্টু ছুটে আসে। বাড়ি আসার পথেই রেল লাইনের ধারে পড়ে থাকা ভাইদের লাশ দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। গ্রামের লোকজন লাশ গুলো নিয়ে এসে বাড়ির পিছনে এক সারিতে দাফন করে। শহীদদের স্ত্রী, সন্তান নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় পড়ে মন্টু মিয়া। তরিফত ব্যাপারীর স্ত্রী জমিলা বেওয়া পুত্র হারা শোকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে মৃত্যু বরণ করেন। তাকেও শহীদ পুত্রদের কবরের পার্শ্বে দাফন করা হয়। শহীদ কছির উদ্দিনের ২ছেলে ১ মেয়ে রয়েছে। এক ছেলে দিনমজুর অপর ছেলে ফল ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে। মেয়েকে বিয়ে দিয়ে এখন তিনি রিক্ত হস্ত।
দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান শোক সমবেদনা ও সহানুভূতি জানিয়ে ২ হাজার টাকা অনুদান (চেক নং-সি-এ-০১২৩০৮) বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত পত্র (প্র, ত্রা, ক ৬-৪-৭২/সি-ডি/১৮৮৬ তাং ১৮/১১/৭২ ইং) এবং ত্রাণ তহবিল থেকে ২ বান্ডিল ঢেউটিন সাহায্য পাঠিয়ে দেন। দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ এ পরিবারটির কাছে অর্থ চেয়ে প্রয়াত বঙ্গবন্ধ শেখ মজিবর রহমান এর বার্তাটি মহামূল্যবান বলে অভিহিত করে এ প্রতিবেদকের নিকট মন্টু মিয়া কেঁদে ফেলেন।
শহীদদের উত্তর সুরী আব্দুল জব্বার মন্টু জানান, তিনি একটি ভাঙ্গা সেলাই মেশিন দিয়ে পরিবারের ভরণ পোষণ চালিয়ে যাচ্ছেন। দিন কাটছে কোন রকমে। সেলাই মেশিনের চাকার সাথে সাথে তার অভাবী জীবন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। অর্থের অভাবে কবর স্থানটি পাকা করা যাচ্ছে না। বাঁশের বেড়া দিয়ে শুধু চিহ্ন করে রাখা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমান এর মৃত্যুর পর অনেক সরকার ক্ষমতায় এসেছে। কবর স্থানটি পাকা করণ এর জন্য আবেদন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান এর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
//নিউজ/উলিপুর//মালেক/ডিসেম্বর/০৫/২২