।। নিউজ ডেস্ক ।।
উলিপুরে নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পুনর্বাসন সহায়তা প্রকল্পের প্রায় ১ কোটি ১৫ লাখ টাকার সিংহভাগ কেটে নিয়েছে শাসক দলীয় নেতা, ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানের ক্যাডাররা। তালিকাভূক্ত মানুষজনের অভিযোগ, টাকা কেটে বা কেড়ে নেওয়ার সময়, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, পিআইও, ব্যাংক কর্মকর্তা, ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বারদের নামও উল্লেখ করেছে টাকা আদায়কারীরা। কারও নামে বরাদ্দ করা ৭৫ হাজার টাকার ৫০ হাজার, ৬০ হাজার টাকার ৪০ হাজার এবং ৫০ হাজার টাকার ৩০ হাজার টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে। টাকা কেটে নিয়েছে উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, হাতিয়া ইউপি সদস্য হাফিজুর রহমান ও তার ছোট ভাই মোখলেছুর রহমান। এ ব্যাপারে প্রকল্পের তালিকাভুক্ত মানুষজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিস সূত্র জানায় ‘নদী ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পুনর্বাসন সহায়তা প্রকল্পে উপজেলায় ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। এই টাকা ২১০টি পরিবারের মধ্যে বিতরণ করা হয়। পাঁচের অধিক সদস্যের পরিবারের জন্য ৭৫ হাজার টাকা, ৫ সদস্য পরিবারের জন্য ৬০ হাজার টাকা ও ৪ সদস্য পরিবারের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। হাতিয়া ইউনিয়নে ৩০ জন, থেতরাই ইউনিয়নে ৩২ জন, বজরা ইউনিয়নে ২৫ জন, দলদলিয়া ইউনিয়নে ৩৩ জন ও বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে ৯০ জন পরিবারের নামে এই টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
হাতিয়া বকশী গ্রামের দেয়ানত উল্যার পুত্র আজিজুল হক জানান, ‘আমি গত ২ সেপ্টেম্বর উলিপুর কৃষি ব্যাংক থেকে ৭৫ হাজার টাকা তুলি। ব্যাংক থেকে বের হওয়ার সময় হাতিয়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমার সব টাকা নিয়ে নেন। এতে আপত্তি জানালে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে বাকি ৫০ হাজার টাকা নিয়ে আমাকে ধমক দিয়ে বিদায় করে দেন। বাহে ‘টাকাগুলা দিন-ডাকাতি করি নিল।
একই গ্রামের কাশেম আলী পুত্র আব্দুর রহিম জানান, ‘আমি গত ২৮ সেপ্টেম্বর আমার নামে বরাদ্দ সরকারি সাহায্যের ৭৫ হাজার টাকা তুলতে উলিপুর কৃষি ব্যাংকে যাই। তোলার পর আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল ইসলাম টাকা গুলো আমার হাত থেকে নিয়ে নেন। প্রতিবাদ জানালে তিনি বলেন, ‘এই টাকা হাতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, উপজেলা কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তা, ইউএনও এবং জনপ্রতিনিধিদের দিতে হবে। আমাকে ধমক দিয়ে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে বাকি ৫০ হাজার টাকা নিয়ে নেন। আমার আপন ভাই রাজু মিয়ার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা কেড়ে নিয়েছেন তিনি।
একই কথা জানান, আজিজল হকের পুত্র সিরাজুল ইসলাম। একইভাবে শামছুল আলমের ৭৪ হাজার ৬’শ টাকার মধ্যে ২৭ হাজার টাকা তাকে দিয়ে বাকি টাকা কেড়ে নেন তিনি। ব্যাংকের পাশে ‘ছ’ মিলসংলগ্ন একটি গুদামে তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘নয়া চেয়ারম্যানকে দিতে হবে। উপজেলা চেয়ারম্যানকে দিতে হবে। তারপর ধমক দিয়ে তাকে বিদায় করে দেন।
বাবুর চর গ্রামের নুরবক্ত মিয়া জানান, তার ৫০ হাজার টাকা ব্যাংক থেকে তোলার পর স্থানীয় ইউপি মেম্বার হাফিজুর রহমান তাকে ধরে নিয়ে এসে অটোবাইকে তুলে অনন্তপুর বাজারের দক্ষিণ পাশে এক আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে বাকি ৩০ হাজার টাকা নিয়ে যায় মেম্বার। প্রতিবাদ জানালে তাকে হুমকি দেওয়া হয়।
একই গ্রামের শহিদুর রহমান জানান, তার ৬০ হাজার টাকার ৪০ হাজার টাকা কেড়ে নেন হাফিজুর মেম্বারের ভাই মোখলেছুর রহমান। এসময় মেম্বার উপস্থিত ছিলেন। বাকি টাকা চাইলে তাকে বলা হয়, ‘এই টাকা হাতিয়ার চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, ব্যাংক কর্মকর্তা, ইউএনও এবং বিভিন্ন নেতাকে ভাগ করে দিতে হবে। লুৎফর রহমান, মুকুল মিয়া, ফুল বাবু এবং আবু সাঈদের ক্ষেত্রেও একই রকমের ঘটনা ঘটেছে। তাদের কাছ থেকে বরাদ্দের টাকা কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
এদিকে থেতরাই, বজরা, দলদলিয়া ও বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে পুনর্বাসন সহায়তা প্রকল্পের টাকা লুটপাট করে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
হাতিয়া ইউপি সদস্য হাফিজুর রহমানের সাথে কথা হলে তিনি জোর করে টাকা আদায়ের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘এই অভিযোগ মিথ্যা।
হাতিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বলেন, আমি এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত না। আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইউপি চেয়ারম্যান জানান, ‘এই আদায়ের বিষয়টি একটি ‘চেইন-ওয়ার্ক। চেয়ারম্যান, মেম্বার, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাসহ অনেকে এই চেইনের অংশ।
হাতিয়া ইউপি চেয়ারম্যান শায়খুল ইসলাম নয়া বলেন, টাকা আদায়ের বিষয় আমার জানা নেই। কেউ যদি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে থাকে তাহলে সম্পূর্ণ মিথ্যা।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সিরাজুদৌলা বলেন, টাকা আদায়ের ঘটনা শুনেছি। আমাকে কেউ অভিযোগ করেনি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার শোভন রাংসা বলেন, এ ব্যাপারে অভিযোগ পাওয়ার পর জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। তিনি নিজে থেকে তদন্ত করার ব্যবস্থা করবেন বলে জানিয়েছেন।
কুড়িগ্রাম-৩ (উলিপুর) আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক এম এ মতিন বলেন, তালিতা তৈরি কিংবা টাকা বিতরণে আমাকে জানানো হয়নি। এই অর্থ আদায়ের সাথে যারা জড়িত তারা যেই হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
//নিউজ/উলিপুর//মালেক/অক্টোবর/১৭/২২