।। নিউজ ডেস্ক ।।
বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধনের জাল সনদ দিয়ে কুড়িগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার অভিযোগ বেশ পুরোনো। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হলেও নেই তার বাস্তবায়ন। কিন্তু বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন জাল সনদধারীরা। সম্প্রতি ভূরুঙ্গামারীতে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় আবারও আলোচনায় এসেছে জাল সনদের বিষয়টি।
ভূরুঙ্গামারীতে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় দেশ জুড়ে চলছে তোলপাড়। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় কয়েকজন শিক্ষক গ্রেফতার হওয়ায় শিক্ষকদের অনিয়ম, দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাল সনদ দিয়ে চাকুরি করাসহ নানা অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এনিয়ে তদন্ত হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। গত বছর এনটিআরসি কর্তৃক ১০৫জন শিক্ষকের সনদের সঠিকতার তথ্য প্রকাশ করা হয়। সেখানে ৭৭জন শিক্ষকের জাল সনদের তথ্য উঠে আসে। এর প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার সুপারিশ করা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। উল্টো জাল সনদধারীরা বেতন ভাতা নিয়মিত তুলে আসছেন। অন্যদিকে এসএসসি প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় ৬জনকে ইতোমধ্যে পুলিশ গ্রেফতার করে ৩জনকে রিমান্ডে নিয়েছেন। গ্রেফতারকৃত ৬জন হলেন, ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমান, ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক আমিনুর রহমান রাসেল, ইসলাম শিক্ষার শিক্ষক মাওলানা জোবায়ের হোসেন, কৃষি বিজ্ঞানের শিক্ষক হামিদুর রহমান, বাংলা বিষয়েল শিক্ষক সোহেল আল মামুন এবং অফিস সহায়ক সুজন মিয়া। এই ঘটনায় ওই বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী আবু হানিফ (৪৮)পলাতক রয়েছেন। পলাতক আবু হানিফ নাগেশ্বরী রামখানা ইউনিয়নের পূর্ব রামখানা গ্রামের বাসিন্দা মৃত: বাহার আলী পুত্র। তবে অভিযুক্ত সবাইকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি।
অনুসন্ধানে দেখাযায়, ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমানের স্বাক্ষরিত ২৭(৪৬৮)/২০১৩ স্মারকে ১৫ জুন ২০১৩সালে ইসলাম শিক্ষার শিক্ষক পদে অস্থায়ীভাবে জোবায়ের হোসেনকে নিয়োগ দেয়া হয়। একই বছরের ১০জুন নিয়োগ নির্বাচনী বোর্ডের সুপারিশ এবং বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির ১৪জুন সিদ্ধান্ত মোতাবেক এই নিয়োগ প্রদান করা হয়। পত্রে ৭দিনের মধ্যে যোগদান করার জন্য বলা হলেও শিক্ষক জোবায়ের হোসেন ১৬জুন সকালে যোগদান করেন। এরপর ওই শিক্ষকের এমপিও করার জন্য তথ্য প্রেরণ করা হলে সেখানে ধরা পড়ে জোবাইর জোবায়ের হোসেনের শিক্ষক নিবন্ধন সনদটি ভুয়া। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ)র পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও প্রত্যয়ন-৩ এর সহকারী পরিচালক তাজুল ইসলাম স্বাক্ষরিত শিক্ষক নিবন্ধন সনদ যাচাই সনদে তা প্রকাশ পায়। চলতি বছরের ১০এপ্রিল স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে-৩৭.০৫.০০০০.০১০.০৫.০০২.২০.৩৫৮নং স্মারকে বলা হয়, ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ইসলাম শিক্ষার শিক্ষক জোবায়ের হোসেনের শিক্ষক নিবন্ধন সনদে দেখা যায়, ২০১২সালে বাধ্যতামূলক-৪৮ এবং অপশনাল-৫০নম্বরসহ গড় ৫০নম্বর পেয়ে ৮ম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাশ করেন। তার রোল-৩২১১০৩৩৫ নম্বরে শিক্ষক জোবায়ের হোসেনের পরিবর্তে ফরিদপুর জেলার সাধারণ বিজ্ঞানের সহকারী শিক্ষক মো: কাওছার খানের তথ্য পাওয়া যায়। শিক্ষক জোবায়ের হোসেনের এনটিআরসি সনদটি জাল ও ভুয়া হওয়ায় তার বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে থানায় মামলা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রাপক হিসেবে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের মূল হোতা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আটককৃত লুৎফর রহমান বিষয়টি গোপন রাখেন।
এছাড়াও অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, ফুলবাড়ি উপজেলার সুজনের কুঠি রুহুল আমিন দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক নাসরিন সুলতানার কম্পিউটার বিষয়ের শিক্ষকের এনটিরআরসি সনদটিও ভুয়া। অথচ এই বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন দাস লিখিতভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার সুপারিশ করলেও তা আজও কার্যকর হয়নি। এই শিক্ষক এখনও নিয়মিত বেতন ভাতা উত্তোলন করছেন। নাসরিন সুলতানা ২০০৯সালে চাকুরিতে প্রবেশ করলেও তার এমপিও হয় ২০১০সালে। তার ১২১১১৫৪৩নং রোল অনুযায়ী নিবন্ধন সনদে বাধ্যতামূলক-৬০ এবং অপশনাল-৪০ নম্বরসহ গড়ে ৫০নম্বর পেয়ে কম্পিউটার স্টাডিজ বিভাগ নিয়ে ২০০৮ সালে পাশ করেন। অথচ এনটিআরসিএ ২০২১সালে ১০৫জন শিক্ষকের নিবন্ধন সনদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। যার স্মারক নং-ডিআইএ/এনটিআরসিএ/ রাজশাহী/৯৭৭ তারিখ-২৯সেপ্টেম্বর ২০১৬। এই স্মারকে সহকারী পরিচালক (শিক্ষাতত্ব ও শিক্ষা মান) লোকমান হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয় ১০৫জনের মধ্যে ৭৭জন শিক্ষকের এনটিআরসি সনদ ভুয়া। এরমধ্যে ১০৩নং তালিকায় নাসরিন সুলতানার নিবন্ধন সনদটি জাল হিসেবে বলা হয়। তদন্ত পূবর্ক চলতি বছরের ৩১জানুয়ারি ০৫.৪৭.৪৯১৮.০০০.০২.০৬১.২১.৬৮ স্মারক নম্বরে ওই শিক্ষকের বেতন ভাতা বন্ধের সুপারিশ করে জেলা প্রশাসক বরাবর একটি পত্র দেন ফুলবাড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন দাস।
ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মাহমুদুর রহমান রোজেন (ভূরুঙ্গামারী সদর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান) বলেন, শিক্ষক জোবায়ের হোসেনের এনটিআরসি সনদ জাল কিনা আমি জানি না।
বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এটিএম খলিলুর রহমানও জানান, শিক্ষক জোবায়ের হোসেনের এনটিআরসি সনদ জাল কিনা আমার জানা নেই। এই বিষয়ে কোন চিঠি এসেছিল কিনা সাবেক প্রধান শিক্ষক কাউকে বলেন নি।
জাল সনদের অভিযুক্ত শিক্ষক নাসরিন সুলতানা বলেন, এনটিআরসি সনদটি পেয়েছি মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস থেকে ২০০৮-০৯ সালে। অনলাইনের মাধ্যমে জানতে পেরেছি সনদটি ভুয়া। তবে এই বিষয়ে শিক্ষা অফিস বা মাদ্রাসা সুপারের কোন লিখিত নির্দেশনা পাইনি।
বিষয়টি নিয়ে ফুলবাড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন দাস বলেন, নাসরিন সুলতানার বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন সনদটি জাল প্রমাণিত হয়েছে। তার বেতন ভাতা বন্ধের জন্য সুপারিশ করে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নিকট তথ্য পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলম জানান, জাল সনদধারীদের বিষয়ে এনটিআরসি থেকে সনদ যাচাইয়ের কোন নির্দেশনা আসেনি। তালিকা পেলে সেগুলো যাচাই বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হবে ।
জেলা মাধ্যমিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কুড়িগ্রামের ৯টি উপজেলায় এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫৪৪টি। এরমধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক-৩২টি, মাধ্যমিক-২৭০টি, মাদ্রাসা-২০৩টি, স্কুল এন্ড কলেজ-১২টি এবং কলেজ-২৭টি।